ড. এম শামসুল আলম: পাড়াগাঁয়ে বড় হয়েছি। ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির প্রতিক্রিয়ায় প্রায়ই গ্রামীণ জীবনযাত্রার ঘটনা মনে পড়ে। তখন গ্রামের প্রায় সবাই কৃষক, না হয় কৃষিশ্রমিক ছিলেন। গ্রামের মানুষ খাল-বিল, পুকুর ও নদী-নালায় মাছ ধরত। বাড়িতে শাক-সবজি ও ফল-মূলের বাগান ছিল। বাড়ির আশপাশের ছোটখাটো জঙ্গল থেকে রান্নার জ্বালানি পেত। বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও পশু-প্রাণী পালন হতো। ধান, চাল, তেল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ও রসুন হতো। কোনো কিছুই কিনতে হতো না, নুন ও কেরোসিন ছাড়া।
তাঁতিরা কাপড় বুনানো, কামাররা কৃষি যন্ত্রপাতি বানানো এবং কুমাররা মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানানো, মাঝি নদী পারাপার ও জেলেরা মাছ ধরার কাজ করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করত। কৃষকরা এদের পণ্য বা সেবা গ্রহণ করত ধানের বিনিময়ে। পণ্য বা সেবার মূল্য ছিল না। কিন্তু চাহিদা ছিল। চাহিদা ও জোগান নিয়ন্ত্রণ করে পণ্য বা সেবার মূল্যবৃদ্ধি দ্বারা বেশি বেশি টাকা-কড়ি করার মতো কোনো তত্ত্ব তখনো গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দেয়নি।
পণ্যের বাজার বলে কিছু ছিল না। পণ্য/সেবা একে অপরের মধ্যে বিনিময় হতো। তারা কেউ ক্রেতা বা বিক্রেতা ছিলেন না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে কৃষকের হাতে পাট বিক্রির টাকা আসত এবং মাংস কিনত। মৌসুম জুড়ে বাড়িময় মাটির পাতিলে রান্না করা সস্তায় কেনা ইলিশ সুগন্ধ ছড়াত। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি, এই সেই স্বনির্ভর অর্থনীতি। সেখানে লুণ্ঠন এবং শোষক ও শোষিতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। লুণ্ঠনমুক্ত শোষণ ও বৈষম্যহীন সেই গ্রামীণ সমাজে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা স্ফীতির কোনো ধারণাই ছিল না।
শহরের মতো গ্রামের মানুষকে এখন সব কিছু কিনতে হয়। টাকার দাম যে অনুপাতে কমছে এবং পণ্যের দাম যে অনুপাতে বাড়ছে, সে অনুপাতে সেখানকার মানুষের আয় বাড়ছে না। আয়ের অন্বেষণে মানুষ ঘর ছাড়া, ভিটেমাটি ছাড়া, গ্রাম ছাড়া, দেশ ছাড়া, শিকড় ছেঁড়া প্রকৃতিতে ভাসমান এক অদ্ভুত বিচ্ছিন্ন প্রাণী।
এখন দেখা যায়, জোগান যথেষ্ট থাকার পরও পণ্যের মূল্য হঠাৎ দেড়-দুই গুণ বৃদ্ধি পায়। একেক সময় একেক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। জনগণের পকেট থেকে এক-দুই সপ্তাহেই বাড়তি দেড়-দুই হাজার কোটি টাকা বর্ষার ঢলের মতো বেরিয়ে যায়। কখনো চিনি, কখনো তেল, কখনো চাল, কখনো ডাল এমন সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ম করে চক্রাকারে বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এখন ইলিশ মাছ, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন ও কাঁচা মরিচ মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে।
রপ্তানি আয় ও রপ্তানিকারকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ভারত থেকে পণ্য আমদানি ঝুঁকিমুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার ইলিশ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বাজার অলিগোপলির শিকার হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী তথা অলিগার্করা ইচ্ছামাফিক ব্যয় সংযোজন করে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করার সুযোগ নেয়। এভাবে লুণ্ঠন ও শোষণ একটি কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। খুচরা পর্যায়ের কেনাবেচায় লুণ্ঠনমূলক মুনাফা কম। আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ে অনেক বেশি। এই পর্যায়ের লুণ্ঠন সামনে আসে না, অদৃশ্যেই থাকে।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতা তথা রাজনীতি লুণ্ঠনকারীর দখলে থাকে। ফলে লুণ্ঠন সুরক্ষায় অধিকাংশ রাজনীতিবিদ লুণ্ঠনকারীর আসনে বসে। দিন শেষে রাজনীতি কলুষিত হয়। সঠিক দামে, সঠিক মাপে ও সঠিক মানে লুণ্ঠনমূলক মুনাফামুক্ত পণ্য ও সেবা পাওয়া ভোক্তার অধিকার।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৮, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট আইন ২০১৮ এবং এনার্জির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩ দ্বারা রাষ্ট্র সে অধিকার সংরক্ষণ করে। এসব আইন লুণ্ঠন ও শোষণ থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে অকার্যকর। ফলে প্রক্রিয়াগত ভাবে লুণ্ঠন ও শোষণের কারণে মূল্যবৃদ্ধি তীব্রতর হচ্ছে। বৈষম্য বাড়ছে। সরকার পরিবর্তন হলেও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না হওয়ায় সমাজ লুণ্ঠন ও শোষণমুক্ত এবং বৈষম্যবিহীন হয়নি। মূল্যস্ফীতি থামেনি, থামে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের নীতি-রাজনীতি। আধুনিক সমাজে জনগণ মনে করে, সে-নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই : শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ। আদিকালের রাজা-বাদশারা লুণ্ঠন ও শোষণের লক্ষ্যে একটার পর একটা রাষ্ট্র দখলে নিত। এখন একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে অর্থনীতি দখলে নেয়। এর নাম কূটনীতি ও ভূ-রাজনীতি। এমন নীতি ও কৌশলের কারণে ইলিশ রপ্তানি এবং আলু মরিচের মতো খাদ্যপণ্য ও চিকিৎসার মতো সেবা আমদানি হয়। জাতি উৎপাদন সক্ষমতা তথা প্রজনন ক্ষমতা হারায়। অলিগার্কদের জন্ম দেয়। এমনকি সরকারও অলিগার্কে পরিণত হয়। রাজনীতি তখন ভেতর ও বাইরে থেকে লুণ্ঠন ও শোষণমূলক রাজনীতিতে পরিণত হয় এবং জনগণ ভেতর ও বাহির থেকে পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতের শিকার হয়। পরিণতিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। রক্তক্ষয়, প্রাণহানি, গণ-অভ্যুত্থান। সরকার পতন। এ যেন জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ শীর্ষক উপন্যাসেরই এক অনবদ্য পুনরাবৃত্তি। এর শেষ কখন, কোথায় ও কীভাবে এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা চলেছে জহির রায়হানের এই উপন্যাসে। আমরা চেষ্টা চালিয়েছি মূল্যবৃদ্ধি, বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান ও সংবিধানে উল্লিখিত রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের মধ্যে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদ কর্র্তৃক গৃহীত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে বলবৎ হয়। এর প্রস্তাবনায় বলা আছে :
“… আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মত্যাগ ও বীর শহীদকে প্রাণ উৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি; আমরা আরও অঙ্গীকার করতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;…”
এই অঙ্গীকার প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মূলনীতি হওয়ার কথা ছিল। অথচ পণ্য বা সেবার মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায়, লুণ্ঠন ও অলিগার্ক সৃষ্টিই রাজনীতি তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মূলনীতি হয়ে উঠেছে। এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি বিদ্যমান আইনকানুন অকার্যকর করেছে। এমনকি দেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করার মতো পবিত্র দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতাই ০৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তোলে।
স্বল্পমেয়াদি বর্তমান সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রের আজকের রূপান্তর রাজনীতিতে রূপান্তরের অবকাশ সৃষ্টি করেছে। সংবিধানের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে রাজনীতির মূলনীতি নিশ্চিত হওয়ার সময় বয়ে যাচ্ছে। লুণ্ঠন ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করার চালিয়ে যাওয়া লড়াইয়ে এখনই জয়ী হওয়ার সময়। শাসকের একচেটিয়া কর্র্তৃত্বের বিরুদ্ধে সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় সঙ্ঘবদ্ধ গণতান্ত্রিক সামাজিক শক্তি লুণ্ঠন, শোষণ ও বৈষম্য থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেবে। লুণ্ঠনমূলক মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপ থেকে রাজনীতির এই রূপান্তর জনগণকে চিরতরে মুক্তি দেবে, আমাদের এমনই প্রত্যাশা।
লেখক: জ্বালানি উপদেষ্টা, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, দেশ রূপান্তর।