বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্যমতে, নিকট অতীতে তৈরি পোশাকশিল্প খাতের প্রায় ৩ লাখ ২৪ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। সমসাময়িক কালে এই খাতের প্রায় ২০০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর বেশির ভাগই উপচুক্তি বা সাব-কন্ট্রাক্ট নির্ভর উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল।
বিগত ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা শুরু এবং তৎপরবর্তী সময়ে সরাসরি ছাঁটাই হয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। তাঁরা নিকট অতীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রায় ৯০টি কারখানায় নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ আরও বলছে, করোনাকালে ৫৬ শতাংশ তৈরি পোশাকশ্রমিক নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে দেনার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাঁদের ৭২ শতাংশ শ্রমিকই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পারেননি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কাজ করছেন। মহামারির শুরুতে মালিক পক্ষসহ অন্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কালবিলম্ব না করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে তা আরও বর্ধিত করে।
মালিকেরা ন্যূনতম এবং সহজ শর্তে ঘোষিত তহবিল থেকে ঋণ নেন মূলত কারখানাশ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের কথা বলে। করোনা মহামারি শুরুর প্রাক্কালে জনমত এরূপ প্রণোদনার পক্ষেই ছিল ধরে নেওয়া যায়। কেননা সে সময় মনে করা হয়েছিল, করোনার প্রভাব অন্যান্য খাতের মতো পোশাক খাতেও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। শুরুতে অন্যান্য খাতের মতো তৈরি পোশাক কারখানায়ও ছুটি ঘোষণা করা হয়। যদিও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এসব কারখানা পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হয়। আমরা দেখেছি, সে সময় কীভাবে শ্রমিকেরা দূরদূরান্ত থেকে হেঁটে, ভ্যান-রিকশায় চড়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে রাজধানীতে ফেরত এসেছিলেন। সে সময় কারখানা মালিক পক্ষ এ জন্য বেশ সমালোচনারও মুখোমুখি হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, মালিক পক্ষ প্রণোদনা তহবিল বাড়ানো, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রভৃতি সুবিধার জন্য পুনরায় সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। সরকার বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠীর স্বার্থের কথা ভেবে অনেক ক্ষেত্রেই নমনীয় থেকেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রণোদনায় ছাড় করা তহবিলের পুরোটা ব্যবহৃত হয়নি।
প্রশ্ন হলো, শ্রমিক স্বার্থে সরকারের ত্বরিত মজুরি তহবিল গঠন ও প্রণোদনা সহায়তার অন্য কোনো দক্ষ বিকল্প ছিল কি না? আপৎকালীন বিবেচনায় তড়িঘড়ি মজুরি তহবিল গঠনে সরকার ভূমিকা নিয়েছিল বৃহত্তর শ্রমিক স্বার্থের কথা ভেবেই। সত্যিই যদি মাসের পর মাস কারখানা বন্ধ থাকত, তাহলে ছদ্ম বেকারত্বের কশাঘাতে এমনিতেই টালমাটাল অর্থনীতিতে আরও গভীর ক্ষত সৃষ্টি হতো। শঙ্কা বিবেচনায় তাই আপৎকালীন প্রণোদনা তহবিলের উপযোগিতা ছিল।
এটাও ঠিক, ২০২০ সালে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। রপ্তানি কমার জন্য অবশ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা মোটেই দায়ী নয়। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সংকোচনই দায়ী। বাংলাদেশের মতো অন্যান্য শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক যেমন চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রভূত দেশেও আলোচ্য খাতে রপ্তানি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
সে যা-ই হোক, কথা হচ্ছে প্রণোদনা তহবিল গঠন ও তার কার্যকর ব্যবহারের পরও শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি এবং জীবনমান ধরে রাখতে ব্যর্থতার কারণ কী? এর কারণ বিশ্লেষণে অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন তত্ত্ব স্মরণ করা যেতে পারে। প্রথমত, উৎপাদনের মৌলিক দুই উপাদান তথা মালিকের মূলধন এবং শ্রমিকের শ্রম সর্বদা অপরিহার্য কিন্তু সাংঘর্ষিক। মূলধন, মালিকের মুনাফা এবং শ্রমিকের মজুরি তাই সদা বিপরীতমুখী আচরণ করে। মালিক পক্ষ মুনাফা বাড়াতে জোর দিলে শ্রমিকের মজুরি কমাতে হয়। আবার উল্টো দিকে শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে গেলে মালিকের মুনাফায় টান পড়ে। সে ক্ষেত্রে বণ্টনের সিদ্ধান্ত মালিক কর্তৃক গৃহীত হয় বিধায় শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি নানাভাবে উপেক্ষিত হয়।
কল্যাণকামী অর্থনীতিতে জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য সুষম বণ্টনের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত ভোগ্য ও সেবাপণ্যের উৎপাদন ও তার উপস্থিতি নিশ্চিত করা বোঝায়। সে উদ্দেশ্য পূরণে সরকারের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রয়েছে। শুধু দেখতে হবে নীতিটি বা নীতিসমূহ ফলপ্রসূ হয়েছে কি না। নানামুখী প্রণোদনা সহায়তা ও নীতি গ্রহণের পরও শ্রমিক ছাঁটাই ও কর্মসংস্থান হারানো এসব প্রশ্নকে তাই আরও উসকে দেয়।
করোনা মহামারি সময়ে বাংলাদেশে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা সহায়তা প্যাকেজের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যে মহৎ উদ্দেশ্যে তথা তৈরি পোশাকশ্রমিকদের জীবনমান ধরে রাখা এবং শিল্পকারখানার স্বাভাবিক উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য এই প্রণোদনা সহায়তা, তার সম্যক ব্যবহার হয়েছে কি না, শ্রমিকেরা তার যথেষ্ট সুফল পেয়েছেন কি না, তার কার্যকারিতা নিরূপণ আলোচনা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।