ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন করে ভোক্তা-অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি।
এ সময় অসাধু ও মুনাফা শিকারী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হওয়ার দাবি করে অবিলম্বে তা নিয়ন্ত্রণ করতে নয় দফা দাবি জানানো হয়।
মানবন্ধনে বক্তারা বলেন, বর্তমানে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিই সাধারণ ভোক্তাদের জীবন অতিষ্ঠের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসাধু ও মুনাফা শিকারী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে সব পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী, যা জনজীবনে অত্যন্ত চাপ সৃষ্টি করছে। বর্তমানে ঢাকার খুচরা বাজারে অধিকাংশ সবজির প্রতি কেজি ১০০ টাকার ওপরে।
এছাড়াও, খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের দাম ৬০০ টাকায়ও উঠেছিল। লাল ডিমের দাম প্রতি ডজন ১৭০-১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা দুই মাস আগেও ছিল ১৫০ থেকে ১৬২ টাকা। কিন্তু একজন সাধারণ ক্রেতার এই উচ্চ মূল্যের বাজারের সাথে কিভাবে চলবে, সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার।
সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন উদ্দিন প্রিন্স বলেন, ‘সরকারের লক্ষ্য থাকা উচিত জনগণকে স্বস্তি দেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে এখন সেই স্বস্তি নেই। আর অস্বস্তির কারণেই কিছুদিন আগে (আওয়ামী লীগ) সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারও সেই অস্বস্তি দূর করতে পারছে না। এর কারণ হচ্ছে সরকার পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন হয়েছে সিন্ডিকেটের হাত। কিন্তু অবিলম্বে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের স্বস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সিন্ডিকেটকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের মাধ্যমে আমরা ভেবেছিলাম, দেশে আর বুঝি সিন্ডিকেট থাকবে না। কিন্তু দুই মাস না যেতেই আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে নিত্যপণ্যের বাজার।’
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনি সংস্কারের চিন্তা বাদ দিন। বাজার মূল্য এবং সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত থেকে ডিম আনা হচ্ছে, তারপরও কেন ডিমের বাজার অস্থির। আবার জনগণের সুবিধার জন্য ডিম আমদানি করা হচ্ছে শুল্কমুক্ত ভাবে। কিন্তু তারপরও যদি ডিমের দাম না কমে, তাহলে কি লাভ হলো ডিম আমদানিতে শুল্কমুক্ত করে? তাই সরকারের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ করছি, ক্যাবের দাবিই ১৮ কোটি মানুষের দাবি, সেই দাবি অনুযায়ী দেশজুড়ে রেশনের ব্যবস্থা কার্যকর করে ভোক্তার স্বস্তি ফিরে আনুন।’
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, ‘বাজারের নিত্যপণ্যের দামে হিমশিম খাচ্ছে ভোক্তা। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখছি না সরকারকে। ভোক্তা অধিদপ্তর কাজ করছে। কিন্তু সেটা অপ্রতুল্য, তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়াতে হবে। আমাদের একটাই দাবি, নিত্যপণ্যের মূল্য ভোক্তার নাগালের মধ্যে আনুন।’
জানা যায়, সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য প্রতিটি জেলায় ‘বিশেষ টাস্কফোর্স’ বাজার মনিটরিং করেছে। বিশেষ টাস্কফোর্স টিম উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে দামের পার্থক্য যাচাই করছে ও ব্যবসায়ীদের সতর্ক করছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করা হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ডিমের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে অনেক দিন যাবৎ প্রচেষ্টা চালালেও বাজারে ডিমের দাম বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য মূলত অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি দায়ী। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে ডিম ব্যবসায়ীরা ঢাকার তেজগাঁও পাইকারি বাজারে ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে বাজারে তৈরি হয়েছে ডিমের সংকট। ডিমের বাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অসাধু ও মুনাফা শিকারী ব্যবসায়ী বিশেষ করে ব্যাপারি ও ফড়িয়াদের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এ জন্য দায়ী।
চাল, চিনি, তেল, পেঁয়াজ, আলু, মসলা, আটা-ময়দা, বোতলজাত পানি, ডিম, মাংস কোনো ব্যবসাই এখন আর সিন্ডিকেটের বাইরে নেই। একেক সময় একেক সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ভোক্তাদের নিকট হতে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করছে। হাত বদল হয়েও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যাব মনে করে, বাজারের এই অবৈধ সিন্ডিকেট ভাঙ্গার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে করতে হবে। তা না হলে সিন্ডিকেটের কারণে অসহায় ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই ভোক্তাবান্ধব বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে নয় দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে ক্যাব।
সুপারিশগুলো হলো:
১. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য সারাদেশে `বিশেষ টাস্কফোর্স’ এর কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।
২. পাইকারি ও খুচরা বাজারে সকল পণ্যের বিক্রয়মূল্য দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। এ জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে সারাদেশে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও প্রাপ্তি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।
৪. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি মূল্য, পাইকারি মূল্য ও খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে হবে ও তা বাস্তবায়নের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, মজুদকারী ও মুনাফা শিকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে এবং তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
৬. পেঁয়াজ, রসুন ও আদার অধিকতর চাষাবাদের জন্য বীজ, সার ও লাগসই আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকদের নিকট সহজলভ্য করতে হবে।
৭. প্রাণিজ পুষ্টির চাহিদা পূরণে ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামারিদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।
৮. পেঁয়াজ, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ছাড় দিয়ে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার সুযোগ দিতে হবে এবং পণ্য আমদানির পর তা যেন নির্দিষ্ট দামে বাজারে বিক্রি হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. সড়কে চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন হয়রানি বন্ধ করার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
-এসএম