জ্বালানি খাতে লুণ্ঠনকারীদের তালিকা প্রকাশসহ ২১ দাবি ক্যাবের

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: দেশে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে যেকোনো পর্যায়ের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাতিলের মাধ্যমে জ্বালানি খরচ কমানোর আহ্বান জানায় ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা জাতীয় সংগঠনটি।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি-২০২৪’ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে এক সংলাপে এসব দাবি তুলে ধরা হয়।

এ সময় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাস্তবায়িত রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রামপাল ও মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সকল প্রকার জ্বালানি প্রকল্পের চুক্তি পর্যালোচনারও দাবি জানান বক্তারা।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের সমস্যা মূলত হচ্ছে যে, আমরা একদল লুণ্ঠনকারী তৈরি করেছি এবং রাষ্ট্র এটাকে (জ্বালানি খাত) লুণ্ঠনের ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করেছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনকারীরা লুণ্ঠন করে যাচ্ছে। সেখানে ‘এনার্জি রাইটস’ ও ‘এনার্জি জাস্টিস’- এই দুটো জিনিসকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

তিনি বলেন, ‘এই দুটো জিনিস প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে আমাদের মূল অন্তরায় ছিল সাবেক সরকার ও সরকারপ্রধান (আওয়ামী লীগ সরকার), যিনি ছিলেন লুণ্ঠনের মূল অধিনায়ক। সেই অধিনায়কের যখন বিদায় হয়ে গেছে, তখন সেই জায়গাটা ঠিক করার সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে।’

শামসুল আলম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে- ‘আমরা কিছু করব না।’ অর্থাৎ, সরকার কিছু করবে না। জনগণের জন্য তারা ফ্যাসিলিট্যাটেড করছে এবং সেই সুযোগ তারা সৃষ্টি করেছে। সেই সুযোগ ব্যবহার করে জনগণ তাদের পরিবর্তনগুলো নিশ্চিত করবে।’

এ সময় লুণ্ঠন প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জ্বালানি খাত সংস্কার ও জ্বালানি অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি-২০২৪ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো-

১. কস্ট প্লাস নয়, কস্ট বেসিসে লুণ্ঠনমুক্ত মুনাফাবিহীন জ্বালানি খাত পরিচালনা ও উন্নয়ন নীতির ভিত্তিতে সরকারি সেবা খাত হিসেবে বিইআরসি’র আওতায় অবিলম্বে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি খাত সংস্কার করা।

২. ভর্তুকি ও মূল্যহার বৃদ্ধি ব্যতিত বিদ্যুৎ এবং প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় পরিহার করে ঘাটতি সমন্বয়ের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা।

৩. জনগণের জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য বিগত সরকারের আমলে জনস্বার্থে দায়েরকৃত সকল মামলা সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়া।

৪. বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং ইউটিলিটিসমূহের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ বিইআরসি দ্বারা গঠিত ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নিষ্পত্তি করা।

৫. বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের যেকোনো পর্যায়ের দুর্নীতি ও পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ এবং জ্বালানি অপরাধী হিসেবে বিইআরসি আইনের ধারা ৪৬, ৪৭ ও ৪৯-এর আওতায় তাদের বিচার করা।

৬. সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব ও মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব ও মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং সাবেক বিদ্যুৎ সচিব ও বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামকে জ্বালানি অপরাধী হিসেবে বিচার করা।

৭. পেট্রোলিয়াম পণ্যসমূহের বিদ্যমান মূলাহার ন্যায্য ও যৌক্তিক কি না, তা যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানোর জন্য বিপিসিকে নির্দেশ প্রদান এবং সেই সাথে ২০১২ সাল থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্যহার নির্ধারণ সংক্রান্ত আটকে রাখা তিনটি প্রবিধান কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই অবিলম্বে গেজেটে প্রকাশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।

৮. বিইআরসির চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং সরকারি-যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি/সংস্থাসমূহের চেয়ারম্যান ও সদস্যসহ শীর্ষ পদসমূহের নিয়োগ বিইআরসি আইনের আওতায় প্রণীত প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে করার নিশ্চয়তা প্রদান করা।

৯. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সকল কোম্পানি ও সংস্থার পরিচালনা পর্ষদসহ সকল কমিটি থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা এবং সেই সাথে পদাধিকারবলে কোনো বোর্ড বা কমিটিতে থাকা প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী/কর্মকর্তার জন্য প্রদত্ত যেকোনো প্রকার সম্মানী নিষিদ্ধ করা।

১০. এছাড়া ওইসব কোম্পানি/সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ব্যতীত প্রফিট বোনাস ও এপিএ টার্গেট অ্যাচিভমেন্ট বোনাসসহ সকল প্রকার আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিষিদ্ধ করা।

১১. ব্যক্তি খাত মালিকানাধীন ৪০টি ফার্নেসওয়েলভিত্তিক ৪ হাজার ১৪৬ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চুক্তি মতে ন্যূনতম প্লান্ট ফ্যাক্টরেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না বিধায় তাদের প্রত্যেকটির লাইসেন্স ও পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট বাতিল করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সাথে সকল প্রকার আর্থিক লেনদেন স্থগিত করা।

১২. বিদেশি বিনিয়োগ/ঋণ নেই এমন আটটি ২ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ের ৭০ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ, সেই ঋণ ইতোমধ্যে উসুল হওয়ায় ওইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সংশোধন করা।

১৩. বিগত সরকারের আমলে গৃহীত রুপপুর, রামগাল, মাতারবাড়ি ও পায়রার মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিদ্যুৎ, তরল জ্বালানি, গ্যাস, কয়লা ও রিনিউয়েবল এনার্জি উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের অনিয়ম ও চুক্তি পর্যালোচনা করা।

১৪. আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় লুণ্ঠনমূলক হওয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ভোক্তারা জ্বালানি সুবিচার বঞ্চিত বিধায় আদানির সাথে সম্পাদিত উক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত সকল চুক্তি বাতিল করা।

১৫. জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা স্বল্প ব্যবহার হওয়ার মতো পরিস্থিতির অবসান না হওয়া পর্যন্ত ফসিল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উন্নয়ন না করা।

১৬. ব্যক্তিখাত বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবৈধ ভাবে ভর্তুকিতে গ্যাস দিয়ে বাণিজ্যিক মূল্যহারে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করায় ওইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল করা।

১৭. ছাতক (পূর্ব) গ্যাস ক্ষেত্রের সম্ভাব্য মজুদ ১ টিসিএফ ভোলায় মজুদ ২ টিসিএফ-এর অধিক এবং অন্যান্য ছোট ছোট গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ গ্যাস দেশীয় কোম্পানি দ্বারা উত্তোলন ও দিনে অতিরিক্ত ৫০ থেকে ৬০ কোটি ঘন ফুট গ্রীডে সরবরাহ করা এবং এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা বৃদ্ধি না করা।

১৮. পেশাদার জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ সৎ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত স্বার্থ সংঘাতমুক্ত জাতীয় পর্যায়ের কমিটি দ্বারা সকল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন প্রকল্পের ক্যাপাসিটি চার্জ এবং (Power Purchase Agreement) LTSA (Long Term Service Agreement) সংশোধন করা।

১৯. পল্লী বিদ্যুতের সংকট আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান করা এবং এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যর্থতার মূল্যায়ন করা।

২০. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটর কমিশন আইন ২০০৩-এর মৌলিক সংস্কার করা।

২১. (ক) নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বৈষম্যহীন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুতের বাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ড করা।

(খ) ২০৩০ সাল নাগাদ সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মূল্যহার ভারতের পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি কৌশলগত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা (ভারতের পরিকল্পনা মতে, ২০৩০ সালে মূল্যহার হবে সৌর বিদ্যুতের ১.৯-২.৬ রুপি এবং বায়ু বিদ্যুতের ২.৩-২৬ রুপি)।

(গ) জমি খুঁইয়ে করা বিত্তবান উদ্যোক্তাদের মেগা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিদ্যুতের পরিবর্তে এর অর্ধেক মূল্যহারে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রাপ্তির লক্ষ্যে সম্ভাব্য প্রায় ৫০ হাজার মেগাওয়াট রুপটপ ও অনুৎপাদনশীল ভূমিভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎ এবং প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ উন্নয়ন করা।

(ঘ) রক্ষণশীল আর্থিক প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৩০ সালে বর্তমানের তুলনায় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি ৭.৫০ টাকা মূল্যহারের সৌর বিদ্যুৎ দ্বারা লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নবীন উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কোটি কোটি ভোক্তার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা এবং ৯ হাজার কোটি ইউনিট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য একটি মধ্যমেয়াদী কৌশলা ও পরিকল্পনা করা।

ক্যাবের কো-অর্ডিনেটর (রিসার্চ) সাংবাদিক শুভ কিবরিয়ার সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান, ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজুসহ গণমাধ্যমের জ্বালানি বিটের সাংবাদিকরা।

-এসএম