ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: বিদ্যুৎ, গ্যাস তথা জ্বালানির দাম যখন বাড়ে, তখন সরকারি তরফে বলা হয়, দাম বাড়ানো হচ্ছে না, আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানির দাম বাড়ে এবং আর্থিক ঘাটতি বেশি হয় তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে- এমন ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দাম যখন বছরের পর বছর কম থাকে, তখন দেশে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দাম কমে না। আবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) যখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর গণশুনানি করে, তখন তারা বলে, মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাবের উপর গণশুনানি করছে। এই মূল্যহার পরিবর্তনের বাস্তবিক অর্থ একটাই, কেবলমাত্র ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য বাড়ানো। ফলে সকল পর্যায়ে জনগণের মনে ধারণা হয়েছে, আসলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম কখনই কমে না, কেবল বাড়েই। এই ধারণা আজ অবধি ভুল প্রমাণিত হয়নি।
মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ভোক্তাদের সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বহুবার বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে ক্যাব বারংবার দেখিয়েছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বজায় রেখে কারিগরী ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করে, দুর্নীতি বা লুণ্ঠন ব্যয় বৃদ্ধি ঠেকাতে পারলে, জনবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে জনস্বার্থে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হলে, অপচয়-অবচয় কমালে, ভর্তুকির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হলে, জাতীয় নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের ওপর ভোক্তার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে সার্বজনিন মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হলে এবং অসাধু আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য খর্ব করে জনকর্তৃত্বমূলক সুনীতি গৃহীত হলে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। খরচের খাতগুলো অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্ত হলে ঘাটতি সমন্বয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যহার বার বার এতো বেশি-বেশি বাড়ানো লাগে না। কখনো কখনো কমানোও সম্ভব।
এমন কথা কেবল কথার কথাই নয়। নীতিগত অঙ্গিকারও বটে। লুণ্ঠন বা দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে ভোক্তার সাংবিধানিক ও মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২২ প্রস্তাব করেছে।
জ্বালানি সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা কিংবা স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের সকল পর্যায়ে সক্ষমতা-দক্ষতা-ন্যায্যতা-সমতা-যৌক্তিকতা নিশ্চিত করা জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে অন্যায়, অযৌক্তিক, লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্ত করে ন্যায্য এবং যৌক্তিক মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি নীতির মূল লক্ষ্য। সেই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণ উন্নয়ন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার বৈশ্বিক লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণও মূল উদ্দেশ্য।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ রহিত করা, বাণিজ্যিক বিবেচনায় সরকারের রাজস্ব আহরণের নীতির সংস্কার করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভ্যন্তরীণ বাজারকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে পরিণত করার লক্ষ্যে ভোক্তা আন্দোলন গড়ে তোলাও এই নীতির অন্যতম লক্ষ্য। এই সব বিবেচনায় জ্বালানি রূপান্তর পথনকশা এই নীতির অন্যতম প্রধান গতিমুখ।
প্রস্তাবিত জ্বালানি রুপান্তর নীতির কর্মকৌশল ঠিক করা হয়েছে স্বল্প-মধ্যম-দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার ওপর ভর করে। ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ যেন উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে, সে জন্য ন্যায্য-যৌক্তিক মূল্যহারে পরিবেশবান্ধব নিরবচ্ছিন্ন প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত হতে হবে।
এই নীতির মূল রূপকল্পই হচ্ছে সে লক্ষ্যে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যায্যতা, সমতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে টেকসই জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল প্রয়োগ করে, স্থানীয় প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে জাতীয় সক্ষমতা উন্নয়ন প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। ফলে ভোক্তাবান্ধব মূল্যহার নির্ধারণ নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রেগুলেটরী বা নিয়ন্ত্রক ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের দৃষ্টিভঙ্গী ও আইনি বিধি-বিধান এবং বিনিয়োগ কৌশলেও পরিবর্তন আনা এই নীতির অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।
প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও সক্ষমতা উন্নয়ন কৌশল, জ্বালানি সংরক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কৌশল, মানবসম্পদ উন্নয়ন কৌশল, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল, পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণ কৌশল, আইনি কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও অর্থায়ন কৌশলের মাধ্যমে একটি রূপকল্প, ১৪টি উদ্দেশ্য, ১০৪টি কৌশলগত বিষয় নিয়ে এ নীতিমালা। জাতীয় ক্ষেত্রে এ নীতিমালা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজন এই নীতিমালার স্বত্বাধিকারী। এই প্রস্তাবিত নীতি ভোক্তাদের জ্বালানি অধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষেণের দাবিনামা এবং ভোক্তা আন্দোলনের ইশতেহার।
জ্বালানি সনদ চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। চুক্তিটি ১৯৯৪ সালে প্রণীত হয়। এই চুক্তি জ্বালানি শিল্পে বিশেষত অনবায়নযোগ্য তথা কার্বনসমৃদ্ধ জ্বালানি বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে বহুপক্ষীয়, বহুদেশীয়, আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করে। এই চুক্তি স্বাক্ষরে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই চুক্তিটি শুধু জ্বালানি খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিনিয়োগকারি কোম্পানি, ব্যক্তি কিংবা অংশীদার বা অন্যকোনভাবে এই বিনিয়োগের সাথে সংশ্লিষ্ট তৃতীয় পক্ষকে সুরক্ষা দেয়। বিদেশী বিনিয়োগকারী ও কমিশন এজেন্টদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কারণে জ্বালানি সনদ চুক্তি একেপেশে, ভোক্তা স্বার্থবিরোধি এবং ভারসাম্যহীন। বিরোধ নিরসন প্রক্রিয়া স্বাগতিক রাষ্ট্রের জন্য একটি আইনি ফাঁদ।
সুতরাং জ্বালানি সনদ চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণে বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান কার্যকারীতা হারাবে। ফলে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২২ বাস্তবায়নে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। তাই কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তাপক্ষ থেকে এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে এবং এই চুক্তি স্বাক্ষর না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।