খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি
খাগড়াছড়িতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩৩টি ইটভাটা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত চার দিনে জেলা সদরসহ অন্য আট উপজেলায় অভিযান চালিয়ে এগুলো বন্ধ করে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, একটা রিটের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের সকল ইটভাটা অবৈধ ঘোষণা করে সাত দিনের মধ্যে ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশনা হাতে পৌঁছার পরপরই ইটভাটা বন্ধের অভিযান শুরু করা হয় এবং পর্যায়ক্রমে জেলার ৯টি উপজেলার ৩৩টি ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো বন্ধে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।
রিটে আবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় স্থাপিত ইটভাটাগুলো লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া পাহাড় কেটে মাটি ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে ও বনের গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রিটের শুনানি হয় গত ২৫ জানুয়ারি। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন এইচআরপিবি’এর সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
শুনানি শেষে তিন জেলার সকল অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। সেই সঙ্গে তিন জেলার লাইসেন্সবিহীন সকল ইটভাটার তালিকা আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালকসহ বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে বিপরীত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা। এদিকে ইটের বিকল্প তৈরির বন্দোবস্ত না করে আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ঠিকাদাররা।
পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ ক্রমাগতভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছিলো। ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এতে পাহাড় তার আপন পরিবেশ ফিরে পাবে, প্রকৃতি পাবে নিজস্ব ভারসাম্য।
খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ইটভাটাগুলোতে নির্বিচারেই বনের কাঠ পোঁড়ানো হতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনগুলো দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছিলো। জনবল সংকট ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় বন বিভাগের পক্ষে চাইলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ইটভাটা বন্ধে আদালতের এমন নির্দেশনা পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
জেলা সদরের কমলছড়ি এলাকার ইটভাটা আরপিএস ব্রিকসের শ্রমিক মো. মোস্তফা, মান্নান মিয়া ও রতন মিয়া বলেন, ‘এই ইটভাটায় আমরা অন্তত ৪শ’ থেকে ৬শ’ শ্রমিক কাজ করছি। জেলার প্রতিটি ইটভাটায় এমন সংখ্যক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। ইটভাটায় কাজ করে সামান্য আয় দিয়ে সংসার চলে। হঠাৎ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ায় কয়েক হাজার শ্রমিক পরিবার নিয়ে অনিশ্চতায় পড়েছি।’
মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি এলাকায় স্থাপিত ইটভাটা মেসার্স ইমরান এন্টারপ্রাইজের মালিক এটিএম রাশেদ উদ্দিন বলেন, বেশিরভাগ ইটভাটার মালিকরাই ধার-দেনা করে এবং আগাম ইট বিক্রির টাকা দিয়ে ইটভাটা পরিচালনা করেন। আদালতের এমন নির্দেশনা মৌসুম শুরুর আগে দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই নতুন করে বিনিয়োগ করতো না। মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে ইটভাটা বন্ধের নির্দেশনায় বেশিরভাগ ইটভাটা মালিক দেউলিয়া হয়ে যাবে।
স্থানীয় ঠিকাদার কেএম ইসমাইল হোসেন বলেন, খাগড়াছড়িতে উন্নয়ন কাজ করার জন্যে এখনো ইটের বিকল্প কোনও ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এ জেলায় কংক্রিটের ব্লক তৈরির কোনও কারখানা বা উদ্যোক্তাও নেই।
আরেক ঠিকাদার রিপরিপ চাকমা বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে ইটভাটা বন্ধ কোনও কার্যকরী সমাধান নয়, বরং এটা আপাতভাবে আত্মঘাতীও বটে। এর ফলে পার্বত্য এই তিন জেলার যাবতীয় উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
এইচআরপিবি’র সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, পাহাড়ের পরিবেশ বিনষ্টের প্রধান কারণ ইটভাটা। আশা করি ইটভাটা মালিকরাও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে ইটের ব্যবসা বাদ দিয়ে কংক্রিটের ব্লক তৈরির কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হবেন।