ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:
অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে ৩০ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৩০০ কোটির টাকার অধিক হাতিয়ে নিয়েছে এসএম গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এক হাজার টাকায় একটি আইডি বিক্রি করত তারা। ওই আইডির বিপরীতে চাল, ডাল, তেল, হলুদ, মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মিলত। এভাবে মূলত গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করত প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে আইডিপ্রতি দিনে ২০ টাকা করে ১০০ দিনে দ্বিগুণ মুনাফা অর্থাৎ দুই হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ।
গ্রাহকের আইডিতে মুনাফার টাকা যোগ হলেও ওই টাকা কিন্তু তোলা যেত না। নানাভাবে ঘুরান হতো। এভাবে গ্রাহকদের অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। নামমাত্র অফিস থাকলেও টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করত তারা। প্রাইভেটকারে উঠিয়ে কখনও চলন্ত অবস্থায় লোভনীয় প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করত, কখনও-বা উল্টো নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নামিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে এসএম গ্রুপ ৩০ লাখের অধিক আইডি বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
রাজধানীর ভাটারা থানায় এক ভুক্তভোগীর করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চক্রটির এক সদস্যকে রোববার সকালে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। এরপর বেরিয়ে আসে প্রতারণার অভিনব এ তথ্য।
সিআইডি জানায়, ডিজিটাল মাল্টিলেভেল কোম্পানির (MLM) সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের গ্রেফতার সদস্যের নাম সাইদুর রহমান সোহেল (৪১)। তিনি প্রতিষ্ঠানটির সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত ছিলেন। চক্রের বাকি সদস্যরা এখনও পলাতক।
সিআইডি ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, সাইদুর রহমানকে গ্রেফতারের সময় ভাটারার অফিস থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নয়টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট, একটি প্রাইভেটকার, ২০টি সিল, তিনটি লোহার হাতুড়ি, একটি হকিস্টিক, একটি বেজবল স্টিকসহ দালিলিক আলামত, ছয়টি রেজিস্ট্রার, ডিলার নিয়োগের চুক্তিপত্র ও ১২০টি চাবিসহ চাকরিপ্রার্থীদের বায়োডাটা উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতারণায় জড়িত প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সোহরাব হোসেন শুভ চৌধুরী (৪৫), মার্কেটিং ও অ্যাকাউন্টসের নাজমুন্নাহার (৩২), আইটি ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ (৪৪), ইমন (৩২) ও সোহরাব হোসেন শুভ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন পলাতক আছেন। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
চক্রটির অভিনব প্রতারণার বিষয়ে সিআইডি ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, প্রথমে গ্রাহকদের জন্য আইডি তৈরি করা হতো। এরপর অফার করা হতো যে, বিনিয়োগ করলে ১০০ কার্যদিবসে দ্বিগুণ অর্থ পাবেন। টাকাগুলো বিকাশ অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
তিনি বলেন, এসএম গ্রুপের সদস্যরা প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রথমে এক হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করা একটি আইডির বিপরীতে গ্রাহকদের বিভিন্ন পণ্য যেমন- চাল, ডাল, তেল, হলুদ, মরিচ সরবরাহ করে আস্থার পরিচয় দিত।
‘পরবর্তীতে প্রতিটি আইডির বিপরীতে প্রতিদিন ২০ টাকা করে ১০০ কর্মদিবসে মোট দুই হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত এবং পুরাতন সদস্যরা নতুন কোনো আইডি সংযুক্ত (নতুন গ্রাহক এনে দেওয়া) করতে পারলে প্রতি আইডির বিপরীতে ৩০০ টাকা করে বোনাস দিত। তবে, গ্রাহকদের আইডিতে মুনাফার টাকা যোগ হলেও তারা ওই টাকা তুলতে পারতেন না। বিভিন্ন অজুহাতে তাদের ঘুরান হতো। বিনিয়োগ করা টাকার বিপরীতে তাদের তৈরি করা একটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে গ্রাহকের ক্রয় করা অনলাইন আইডিগুলো প্রদর্শন করা হতো, যা প্রতিদিন আইডিপ্রতি ২০ টাকা করে বৃদ্ধি পেত’— বলেন ওই কর্মকর্তা।
‘প্রতারিত গ্রাহকরা টাকা তুলতে চাইলে এসএম গ্রুপ তাদের জানায় যে, তাদের ব্যবহৃত www.smshare1.com নামক সফটওয়্যারে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সঞ্চিত না হলে কথিত সরকারি নিয়মের কারণে তা গ্রাহকের বিকাশ অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা সম্ভব না। এভাবে অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি করে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।’
সিআইডি’র তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টসহ ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমেও প্রতারণা করে টাকা গ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শত শত ভুক্তভোগী এভাবে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বড় অঙ্কের টাকা হারিয়েছেন। এসএম গ্রুপ ৩০ লাখের অধিক আইডি বিক্রি করেছে। যার বিপরীতে আত্মসাৎ করেছে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা।
খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, চক্রটির সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে ডিলারশিপ নিয়োগ, অনলাইন আইডি ও কোম্পানির শেয়ার বিক্রি, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, এজেন্সির নামে প্রতারণা এবং অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অপকর্ম করেছে। তাদের নামমাত্র অফিস থাকলেও ভিকটিমদের টাকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অফিসে গ্রহণ না করে কৌশলে প্রাইভেটকারে উঠিয়ে চলন্ত অবস্থায় তাড়াহুড়া করে টাকা-পয়সা নিয়ে গাড়ি থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নামিয়ে দিত।