ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: তালের নরম কচি বীজ তালশাঁস নামে পরিচিত। জ্যৈষ্ঠের কাঠ ফাটা রোদে দেহের পানির অভাব দূর করতে তালশাঁসের জুড়ি নেই। পথে-প্রান্তরে, সড়কের পাশে, শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাজার ঘাটে সমান তালে বেচা কেনা হচ্ছে কচি তাল। একেকটি তাল বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা পিস হিসাবে। আর এক তালে পাওয়া যাচ্ছে তিনটি করে শাঁস। সাদা রংয়ের নরম ও রসালো শাঁস খেলেই জুড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণ। ছোট-বড় সবার কাছেই যেন এ তালশাঁস খুব প্রিয়।
সাধারণত বৈশাখের শেষ অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে হাটে বাজারে শুরু হয় তালশাঁস বিক্রির পালা। গ্রাম কিংবা শহরের ব্যস্ততম ও জনবহুল এলাকায় চোখে পড়ে তালশাঁস বিক্রেতাদের ব্যস্ততা। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষের কাছেই তালের শাঁস অতিপ্রিয় একটি সুস্বাদু খাবার। এটি কৃষি বিভাগের তালিকায় ফল হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও অনেকে এটিকে ফল হিসেবেই এখন জানেন।
সরেজমিনে নাটোর শহরের মাদরাসা মোড়, রেলওয়ে স্টেশন বাজার, নিচা বাজার, কানাইখালি, হরিশপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চল থেকে বিক্রেতারা গাছ থেকে সংগ্রহ করা কচি তাল নিয়ে রাস্তার ধারে ভ্যানে করে বিক্রি করছেন। কম দামে কিনে তারা বেশি দামে বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। বাজারে রসালো লিচুর দাম বেশি হওয়ায় এ তালশাঁসের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা।
তালশাঁস বিক্রেতা আহম্মদপুর এলাকার আবু রায়হান জানান, প্রতি বছর এ সময়ে ১০ থেকে ১২টি তালগাছ কেনেন তিনি। প্রতিটি গাছের দাম পড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। একেকটি গাছে ৪০০ থেকে ৫০০টি তাল পাওয়া যায়। তাতে প্রতিটি তালের দাম পড়ে এক টাকার মতো। একেকটি এক টাকার তাল বাজারে কেটে বিক্রি করছেন ১০ টাকা করে। এতে লাভ ভালোই হচ্ছে। তবে গাছ থেকে তাল নামানো খুব কষ্টের। এছাড়া ভ্যানে বহন করে শহরে আনতেও খরচ হয়।
তিনি বলেন, কষ্টের মধ্যেও তালশাঁস বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছি।
শহরের স্টেশন বাজার এলাকায় ভ্রাম্যমাণ তালশাঁস বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, সব বয়সী মানুষের কাছে তালশাঁস পছন্দের খাবার। রসালো ও হালকা মিষ্টির কারণে শিশুরাও বেশ পছন্দ করে। প্রতি বছরই ১৪-১৫টি করে তালগাছ কিনি। এরপর ঘুরে ঘুরে হাট-বাজার ও শহরে তালশাঁস বিক্রি করি। এটি এখন অনেকটা লাভজনক। পথচারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসব তালশাঁস নিজেরা কিনে খান এবং বাড়ির জন্যও কিনে নিয়ে যান।
নলডাঙ্গা উপজেলার বাঁশিলা গ্রামের জাহিদুল ইসলাম জানান, প্রতি বছরই তালশাঁস বিক্রি করে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করেন। খুব অল্প সময় ধরে তাল থাকে। গাছে কাঁচা অবস্থায় তারা গাছ চুক্তিতে এসব তাল কিনে থাকেন। খাওয়ার উপযুক্ত হলেই তা নামিয়ে বাজারে কেটে বিক্রি করে থাকেন। কখনও বাজারে বসে, কখনও ভ্যানে নিয়ে ঘুরে ঘুরে এসব তালশাঁস বিক্রি করেন। দৈনিক গড়ে তিন-চার হাজার টাকার তালশাঁস বিক্রি করেন। কেনা আর পরিবহন, নামানো খরচ বাদে প্রতি পিস তালে সাত-আট টাকা করে লাভ হয়। মৌসুমি অন্যান্য ফলের মত তালশাঁসের বেশ কদর রয়েছে।
নাটোর শহরের কানাইখালি এলাকায় পথচারী আবু জাফর বলেন, দুপুরে বেশ তৃষ্ণা পেয়েছিল। পথের ধারে তালশাঁস বিক্রি করতে দেখে দু’টি তাল ২০ টাকায় কিনেছি। এতে ছয়টি রসালো ও মিষ্টি শাঁস পেয়েছি। তালশাঁস খেয়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুটোই মিটেছে। সুযোগ পেলেই তালশাঁস খাই। কারণ তালশাঁস শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
নাটোর সদর হাসপাতালের সাবেক আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, তালশাঁস মানুষের শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে এবং প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ভিটামিন ‘এ’ থাকায় দৃষ্টি শক্তি প্রখর করে ও হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া তালশাঁসে ভিটামিন ‘সি’ ও ‘বি কমপ্লেক্স’ রয়েছে, যা শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী। ত্বককে সুন্দর, উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় করে তুলতে তালের শাঁসের জুড়ি নেই।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. ইয়াছিন আলী বলেন, তাল উৎপাদন ও বিপণনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই। তাল এখন অনেকটা ফলের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এ সময়ে আম, লিচুর পাশাপাশি সমান তালে তালশাঁস কেনা বেচা হচ্ছে। বলা চলে তালের শাঁস এখন ফলে পরিণত হয়েছে। তালশাঁস মানুষের দেহের জন্য অনেকটাই কার্যকরী ও উপকারী।
তিনি বলেন, তালের উৎপাদন বাড়াতে এবং বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে সরকারি ভাবে প্রতি বছর তাল গাছের চারা ও বীজ রোপণ করা হচ্ছে।