ইলিশের প্রজনন মৌসুমে গত ১৮ দিনে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মায় ইলিশ শিকারের অভিযোগে ২৩৪ জন জেলেকে এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপরও পদ্মায় থেমে নেই ইলিশ শিকার। পদ্মার চরে অন্তত ৩০টি অস্থায়ী হাটে দিনে ও রাতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদী ও চরগুলোতে স্থায়ীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্প না থাকায় মাদারীপুরের শিবচর, শরীয়তপুরের জাজিরা, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং, ঢাকার দোহার, ফরিদপুরের সদরপুর অংশের পদ্মা নদী ও চরগুলোতে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে মা ইলিশসহ ছোট-বড় ইলিশ।
শিবচর উপজেলা মৎস্য বিভাগের সূত্রে জানা যায়, ইলিশের প্রজনন মৌসুম নির্বিঘ্ন করতে দেশের সব নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে ৪ অক্টোবর। ২৫ অক্টোবর রাত ১২টা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা চলবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় গত ১৮ দিনে পদ্মা নদী থেকে প্রায় ৩০০ জন জেলেকে আটক করে নৌ পুলিশ, থানা-পুলিশ ও কোস্টগার্ড। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২৩৪ জন জেলেকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। জব্দ করা হয় ১৪ লাখ ৫২ হাজার মিটার কারেন্ট জালসহ ৬টি ট্রলার।
শিবচর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস ইবনে বলেন, ‘ইলিশ রক্ষায় আমরা সাধ্যমতো অভিযান পরিচালনা করছি। পদ্মায় ৩৭ বার অভিযান চালানো হয়। আমরা জেলেদের ১০০টি অস্থায়ী হাট ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই। দিন–রাত পদ্মায় আমাদের অভিযান চলে। এরপরও জেলেদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমরা সামনে যাকে পাই তাকেই ধরি। অনেকেই পালিয়ে যায়। পদ্মায় জেলেদের কখনোই শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, শিবচরের ৩ হাজার ৮০ জন জেলেকে ৬২ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া আরও ৩৪৫ জন জেলেকে জিআর-এর ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। জেলেদের সরকারি সহযোগিতা করার পরও তাঁরা নিষেধাজ্ঞা মানছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মার চরগুলোর কাশবনের ফাঁকে অস্থায়ী তাঁবু টানিয়ে চলে ইলিশ কেনাবেচা। অনেক সময় সেই মাছ নদীর চরে রেখেই মুঠোফোনের মাধ্যমে নদীপাড়ের প্রত্যন্ত বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা নানা উপায়ে পৌঁছাচ্ছেন প্রত্যন্ত এসব এলাকাগুলোয়। নদীপাড়ে বসেছে অস্থায়ী তাঁবু টানিয়ে হাটবাজার। জেলেদের জালে ধরা পড়া মাছগুলোর পেট ভরা ডিম। জাটকাও ধরা পড়ছে।
চরজানাজাত এলাকার জেলে মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসন নামমাত্র সহায়তা করেছে। তাদের ১০ কেজি চালে কি আর ২২ দিন চলবো? তাই সংসার চালাইতে পদ্মায় মাছ ধরতে যাই। কড়াকড়ি থাকায় আমরা মাছ নিয়ে শহরের হাটে যাই না। মাছ ধরে চরেই কিছু কম দামে বিক্রি করি।’ তিনি জানালেন, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। আর আধা কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। দাম অনেকটা কম থাকায় বিস্তীর্ণ চরেও ক্রেতার অভাব হয় না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা বলেন, ‘শুনেছি, পদ্মার চর মাদবরচরের খাড়াকান্দি এলাকায় কম দামে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তাই ট্রলারে ভেঙে ভেঙে এই চরে এসে কিছু মাছ কিনলাম। মাছের দামও কম। তবে ঝুঁকি নিয়ে মাছ কিনতে হচ্ছে।’
চরজানাজাত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আল-আমিন শেখ বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় প্রশাসনের লোকজন নদীতে দিনে দুবার নামমাত্র টহল দেয়। পাড়ে কেউ আসে না। চরগুলোতে অস্থায়ী বাজার বসিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ইলিশের হাট বসে। নিষেধাজ্ঞার সময় নদীতে যদি স্থায়ীভাবে টহলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে মা ইলিশ নিধন বন্ধ করা সম্ভব।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত দফায় দফায় পদ্মায় অভিযান পরিচালনা করছি। জেলেদের জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। চরগুলোতে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ইলিশ বিক্রির স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয়েছে। তবে মা ইলিশ রক্ষায় স্থায়ীভাবে নদী ও চরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়ন করা প্রয়োজন। তাহলে কার্যকরী ব্যবস্থা হবে।’