নওগাঁর পত্নীতলায় অবৈধ কারখানা দিয়ে ব্যাটারি পুড়িয়ে ক্ষতিকর সিসা তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে দিনে নষ্ট ও পুরোনো ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত বের করা এবং রাতে ওই পাত গলিয়ে সিসা তৈরি করা হয়। এতে আশপাশের পরিবেশ ও জনজীবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নের ত্রিমোহনী-বদলগাছী সড়কের আড়াইল মৌজায় কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। এখানকার ব্যাটারির অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় এসব গড়ে উঠেছে। কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবৈধ কারখানাটি দ্রুত সরানোর দাবি স্থানীয়দের।
জানা গেছে, আমাইড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রফিকুল ইসলামের জমিতে তার ছত্রচ্ছায়ায় আড়াইল মৌজায় পাঁচ মাস ধরে কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। গাইবান্ধা জেলার খায়রুল ইসলামের সহযোগিতায় এক মাস থেকে নষ্ট ও পুরোনো ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত গলিয়ে সিসা তৈরির কাজ করা হয়। কারখানাটি চলে দুই শফিটে। ১৬ জন শ্রমিক দুই শিফটে কাজ করেন।
এক দলের কাজ দিনে পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট (ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত) বের করা, ব্যাটারি থেকে অ্যাসিড সংরক্ষণ এবং ব্যাটারি প্লাস্টিক অংশ আলাদা স্থানে রাখা। আরেক দলের রাত ১০টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত চলে ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত গলিয়ে সিসা তৈরির কাজ।
কারখানা স্থাপনের শুরুতে স্থানীয়রা বাধা দিলে তাদের বলা হয়েছিল, এখানে বরফ (আইস) তৈরির কারখানা করা হবে। কিন্তু পরে স্থানীরা ব্যাটারির কারখানা দেখলেও তারা আর সরাতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাটারি কারখানায় সিসা তৈরির সময় নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ধরনের পদার্থ মানুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগসহ ও ক্যানসারের মতো কঠিন ও জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বিষয়টি জানতে পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, সিসা ও অ্যাসিডযুক্ত ধোঁয়ার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক বিকাশে প্রচণ্ড রকম সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘদিন অ্যাসিড ও সিসাযুক্ত ধোঁয়ার ফলে আগামী প্রজন্ম বিকলাঙ্গ রোগের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া নানা রকমের ক্ষতির কারণ হতে পারে সিসার অ্যাসিডযুক্ত ধোঁয়া।
আড়াইল গ্রামের রাশিদুল ইসলাম বলেন, কারখানাটি স্থাপনের আগে তাদের নিষেধ করেছিলাম। তারপরও কারখানা চালু করে দিনরাত ব্যাটারি থেকে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। এই সিসা ফসল, গাছ, লতাপাতা ও প্রাণী সবার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়, মাথা ঝিমঝিম ভাব হয়। এ অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠা ওই কারখানার কারণে এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া কারখানার আশপাশের ঘাস গরু-ছাগল খেতেও চায় না।
কারখানার শ্রমিক শাহিন বলেন, চুল্লির মধ্যে কাঠ ও কয়লায় অ্যাসিড মিশ্রিত ব্যাটারির বর্জ্য বা প্লেট সাজানো হয়। এরপর আগুন ধরিয়ে দিলে তা গলতে থাকে। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক পাখা থেকে বাতাস দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সিসা তৈরি হয়। গলিত অংশ লোহার কড়াইয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এতে আগুনে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতিকর জেনেও অভাবের তাড়নায় কাজ করছি।
স্থানীয় বাসিন্দা ওই কারখানার ম্যানেজার আলম হোসেন বলেন, এর আগে এই এলাকায় এমন কারখানা ছিল না। তাই এর ক্ষতিকর দিক আমার জানা নেই। এ ছাড়া কারখানার কাগজপত্র সম্পর্কে কিছুই বলতে পারব না। এসব কিছু কারখানার মালিকই বলতে পারবেন। এক মাস ধরে কারখানা চালু হয়েছে। সপ্তাহে দুই ট্রাক ব্যাটারি নিয়ে আসা হয় এখানে।
কারখানার মালিক গাইবান্ধা জেলার খায়রুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের কোনো ছাড়পত্র বা কোনো দফতর থেকেই অনুমোদন নেওয়া হয়নি। সারা দেশে তো এভাবেই এসব কারখানা চলে। তবে এই প্রতিনিধিকে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরাধ করেন তিনি।
আমাইড় ইউপি মেম্বার রফিকুল ইসলামের বলেন, আমার জমিতে এমন কারখানা করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি জানতাম না। এখানে ভাঙারি কেনাবেচার কথা বলে দুই বছরের চুক্তিতে আমার কাছ থেকে জমিটা নেয়। কিন্তু পুরাতন ব্যাটারি কিনে এনে গলিয়ে সিসা তৈরি করে, এটা আমি জানতাম না। এ বিষয়ে আমি জানার পর এক মাস না হতেই আমি তাদের চলে যেতে বলি।
পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাশেদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।