ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: চট্টগ্রাম নগরে সবজির সবচেয়ে বড় আড়ত রেয়াজউদ্দিন বাজার। পাইকারির পাশাপাশি সেখানে খুচরা পর্যায়ের বাজারও আছে। প্রতিদিন ভোরের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে সবজি নিয়ে আসা ট্রাক এই বাজারে ঢোকে। এসব সবজি পরে নগরের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়। বাজারের চৈতন্যগলি অংশে সবজির আড়ত।
সোমবার এসব আড়তে প্রতি কেজি বাঁধাকপি বিক্রি হয়েছে ১৬ থেকে ২২ টাকায়। অথচ এর প্রায় ১৫ গজ সামনে থাকা স্টেশন রোড ও মুরগীহাটা লেনে খুচরা বাজারে একই বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬৫ টাকায়। ফুলকপি, পটল, লাউ, কাঁচা মরিচসহ অন্য সবজিরও একই অবস্থা। প্রতিটির দামের পার্থক্য দুই থেকে আড়াই গুণ পর্যন্ত।
সকালে এই আড়ত এবং ১৫ গজ দূরের খুচরা বাজার ঘুরে বিভিন্ন সবজির দাম যাচাই করেন এই প্রতিবেদক। দেখা যায়, আড়তে যে ফুলকপি প্রতি কেজি ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, খুচরা বাজারে তা ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ২২ থেকে ২৫ টাকা কেজির পটোল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। একই ভাবে ৩৫ থেকে ৪২ টাকার কাঁকরোল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, ১৫ টাকার লাউ ৩০ থেকে ৪০ টাকা আর ৭০ থেকে ৮০ টাকার কাঁচা মরিচ খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।
একই বাজারের দুই অংশে সবজির দামের এমন পার্থক্য নিয়ে উদ্বেগ জানালেন ক্রেতারা। ওই বাজারে কথা হলো নুরুল হক নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বললেন, আড়ত থেকে সবাই কিনতে পারেন না। তাই খুচরা বাজার থেকে কিনতে হয়। অথচ খুচরা বাজারে দাম দ্বিগুণের বেশি।
তবে খুচরা বাজারের বিক্রেতারা বললেন, প্রতিটি বস্তায় পচা, নষ্ট বা নিম্নমানের সবজি থাকে। এসব সবজি ফেলে দিতে হয়। এসবের দাম যোগ করে নতুন দামে সবজি বিক্রি করতে হয় তাঁদের।
ইয়াসিন আহমেদ নামের এক বিক্রেতা দাবি করলেন, ৫০ কেজির সবজির বস্তায় ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত সবজি বাদ পড়ে। যদি দাম সমন্বয় না করা হয়, তাহলে লোকসান গুনতে হবে তাঁদের।
আনুষঙ্গিক খরচ কত
রেয়াজউদ্দিন বাজারে তিন ধরনের বিক্রেতা আছেন। পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতা। আড়ত থেকে সবজি সংগ্রহ করেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। এরপর তাঁদের কাছ থেকে পণ্য কেনেন খুচরা দোকানিরা। এই হাতবদলেই দাম বেড়ে যায় বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা কমিশনের ভিত্তিতে সবজি বিক্রি করে থাকেন। প্রতি ১০০ টাকায় আড়তদারদের কমিশন দিতে হয় ৬ টাকা ২৫ পয়সা। আড়ত থেকে কিনে পাইকারি ও খুচরা হিসেবে বিক্রি করেন আরেক শ্রেণির বিক্রেতা। আড়ত থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে তাঁদের এ দুই খাতে কিছু টাকা খরচ হয়।
দেখা যায়, সব মিলিয়ে প্রতি কেজি সবজিতে আড়তের দামের সঙ্গে ১ থেকে ৫ টাকা আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হয়। অথচ খুচরা বাজারে একই সবজি বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি দামে।
রেয়াজউদ্দিন বাজার আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক শিবলী বলেন, সবজি বিক্রিতে কমিশনের বাইরে আড়তদারদের কোনো লাভ নেই। তাঁরা (আড়তদার) পাইকারদের কাছ থেকে দামের বাইরে শুধু এই কমিশনই নেন। এটাই তাঁদের লাভ।
সবজির দামের পাশাপাশি আড়তদারের কমিশন ও পণ্য দোকানে আনার মজুরি খরচ দিতে হয় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের। প্রতি ৫০ থেকে ৫৫ কেজির একটি বস্তা পরিবহনে মজুরি খরচ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি কেজিতে আড়তের দামের সঙ্গে ১ থেকে ৫ টাকা আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হয়। অথচ খুচরা বাজারে এসব সবজিই দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
নেপথ্যে মধ্যস্বত্বভোগী
সাধারণত আড়ত থেকে পাইকারি বিক্রেতা, এরপর সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতা- এই তিন হাত ঘুরেই সবজি ভোক্তাপর্যায়ে আসে। তবে এই তিন পক্ষ ছাড়াও কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী আছেন। বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব মধ্যস্বত্বভোগীই পণ্যের বাড়তি দামের নেপথ্যের কারণ।
রেয়াজউদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছালামত আলী বলেন, বাজারে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী রয়েছেন। মূলত আড়ত থেকে খুচরায় পণ্য আনার সময় তাঁরাই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এ ছাড়া বাজারের মুখে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও বাড়তি দামে বিক্রি করেন।
একই কথা বললেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, বাজারের মুখে এক দাম, ভেতরে আবার আরেক দাম। আড়ত এবং খুচরায় দামের এই বিশাল পার্থক্যের জন্য দায়ী মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা ছাড়া ভোক্তাদের ভোগান্তি কমবে না। প্রথম আলো।