ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: এবার পানির দাম এক লাফে ৬১ দশমিক ৩৪ শতাংশ বাড়াতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা। অথচ ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর পানির দাম ৩৮ শতাংশ বাড়িয়েছিল সংস্থাটি। ওই সময় এ কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এবার বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে বিদেশি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের অজুহাতে রেকর্ড পরিমাণ পানির দাম বাড়াতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে একসঙ্গে ৬১ দশমিক ৩৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে বলে মনে করছেন গ্রাহকরা। সেবা না বাড়িয়ে বছর বছর দাম বাড়ানোর বিষয়টি মানতে পারছেন না অনেক গ্রাহক।
তবে ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, দাম বাড়ানোর এমন প্রস্তাব উঠে এসেছে গত ১৪ মার্চ চট্টগ্রাম ওয়াসার অনুষ্ঠিত ৭৯তম বোর্ড সভায়। বোর্ড থেকে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে আহ্বায়ক করা হয় সিদ্ধার্থ বড়ুয়াকে। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ প্রস্তাব অনুমোদন হবে। প্রতিবেদন দাখিলের পর তা ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন পেলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দাম বাড়ানোর আবেদন পাঠানো হবে। এরপর প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রণালয় এবং বাড়তি দাম আদায় করবে ওয়াসা।
দাম ২৯ ও ৫৯ টাকা করতে চায় ওয়াসা
চট্টগ্রাম ওয়াসায় বর্তমানে আবাসিকে প্রতি ঘনমিটার (এক হাজার লিটার) পানির দাম ১৮ টাকা এবং অনাবাসিকে প্রতি ঘনমিটার (এক হাজার লিটার) পানির দাম ৩৭ টাকা। এবার আবাসিকে ১৮ টাকার স্থলে ২৯ দশমিক ৪ টাকা এবং ৩৭ টাকার স্থলে ৫৯ দশমিক ৭০ টাকা করতে চায় ওয়াসা।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসায় মোট পানির সংযোগ আছে ৮৮ হাজার ৭৭১টি। এর মধ্যে ৮২ হাজার ৬৪২টি আবাসিক এবং ৬ হাজার ১২৯টি অনাবাসিকে সংযোগ আছে। অর্থাৎ সংযোগের মধ্যে ৯১ শতাংশ পানির ব্যবহার হচ্ছে আবাসিকে এবং ৯ শতাংশ পানির ব্যবহার হচ্ছে অনাবাসিকে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর আবাসিকে ১৮ টাকা এবং অনাবাসিকে ৩৭ টাকা হারে নতুন করে নির্ধারিত হয় চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির দাম। বর্তমানে প্রতি হাজার লিটর পানির বিক্রয় মূল্য পড়ছে ১৯ দশমিক ৭১ টাকা করে।
যে অজুহাতে পানির দাম বাড়াতে চায় ওয়াসা
চট্টগ্রাম ওয়াসার ৭৯তম বোর্ড সভায় পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থিত শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার, ফেজ-২-এর খরচ বিবরণী অনুযায়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, বেতন-ভাতা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার আওতাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সুদ-আসলসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় ক্রমাগত বাড়ার ফলে প্রতি হাজার লিটার পানির উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ৩১ দশমিক ৮০ টাকা। এতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি হাজার লিটার পানিতে ১২ দশমিক ৯ টাকা করে ঘাটতি হচ্ছে। ওই ঘাটতি পূরণ করতে পানির দাম ৬১ দশমিক ৩৪ শতাংশ করে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসার আওতাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে নেওয়া সুদ-আসলসহ মোট ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৫৫৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৯ হাজার ২০৩ টাকা। আগামী অর্থবছর থেকে এসব ঋণের টাকা শোধ করতে হবে ওয়াসাকে।
১৪ বছরে পানির দাম বেড়েছে ১৩ বার
২০০৯ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিকে পানির দাম ছিল ৫ টাকা ৪১ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৫ টাকা ৩২ পয়সা। এরপর প্রতি বছরেই ওয়াসার বোর্ড সভায় পানির দাম ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয়। ২০১৪ সালে পানির দাম হয় আবাসিকে ৬ টাকা ৯০ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৯ টাকা ৫৯ পয়সা। ২০১৫ সালে আবাসিকে ৭ টাকা ২৫ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ২০ টাকা ৫৩ পয়সা, ২০১৬ সালে আবাসিকে ৭ টাকা ৬১ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ২১ টাকা ৫৬ পয়সা, ২০১৭ সালে আবাসিকে ৯ টাকা ও বাণিজ্যিকে ২৫ টাকা, ২০১৮ সালে আবাসিকে ৯ টাকা ৪৫ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ২৬ টাকা ২৫ পয়সা, ২০১৯ সালে আবাসিকে ৯ টাকা ৯২ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ২৭ টাকা ৫৬ পয়সা, ২০২০ সালে আবাসিকে ১২ টাকা ৪০ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা, ২০২১ সালে আবাসিকে ১২ টাকা ৪০ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে আবাসিকে ১৩ টাকা ২ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ৩১ টাকা ৮২ পয়সা এবং ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবাসিকে ১৮ টাকা ও বাণিজ্যিকে ৩৭ টাকা করা হয়।
যা বলছেন গ্রাহকরা
একসঙ্গে এত বেশি পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে নাখোশ গ্রাহকরা। নগরীর মুরাদপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘এখনও নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তাদের পানি না ফুটিয়ে এখনও পান করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে ওয়াসার পানিতে যুক্ত হয়েছে লবণাক্ততা। যে কারণে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। এর মধ্যে ৬১ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রাহকদের চরম কষ্টে ফেলবে।’
নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মো. হাশেম বলেন, ‘এ রমজানেও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে ওয়াসা। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরই পানির দাম বাড়াচ্ছে। বড় অঙ্কের সিস্টেম লসের নামে বড় অঙ্কের অর্থের নয়ছয় করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সিস্টেম লস বন্ধ না করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা অযৌক্তিক।’
কনজুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা এ রমজানেও পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারেনি। প্রতিদিন পানির সংকট লেগেই আছে। এছাড়া ওয়াসায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সিস্টেম লসের নামে চুরি হচ্ছে। আবার ওয়াসার নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পে দেরি হওয়ার কারণে ব্যয় বেড়েছে ৮ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত। এখন এর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে গ্রাহকদের কাঁধে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানির সিস্টেম লসের নামে চুরি বন্ধ করলে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা চাইলে প্রতি বছর ৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়াতে পারে। আমরা এবার ঘাটতি মেটাতে সমন্বয় করতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। এখন বিষয়টি বোর্ডসভা সিদ্ধান্ত দেবে।’