ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: তীব্র গরমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরার শ্যামনগরে খাবার পানিসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক তাপদাহ এই সংকটকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
উপকূলের সর্বত্রই চলছে হাহাকার। এক ফোঁটা পানির জন্য রীতিমতো সংগ্রামে নেমেছে স্থানীয়রা। নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে অনেকেই পুকুরের লবণাক্ত ময়লা পানি পান করছেন।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে স্বাভাবিক সময়েই ৪০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে ভোগে। গ্রীষ্মের খরতাপে বর্তমানে ৫০-৬০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এ তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ বলছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে পান করাসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়া, নদী প্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট ও সরকারি খালগুলো বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ পানির তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন।
সাধারণত শীত মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় উপকূলবাসীকে।
প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সমস্যা তাদের দৈনন্দিন ও প্রাত্যহিক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে।
শ্যামনগর উপকূলের শতাধিক গ্রামে টিউবওয়েলের পানি মাত্রাতিরিক্ত লবণ ও আয়রন যুক্ত হওয়ায় তা একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী। প্রতিবারের মতো এবারও বর্ষা মৌসুম শেষে উপকূলীয় জনপদে লবণাক্ততার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পানীয় জলের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। ২০০৯ সালের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস আইলার পর থেকে এই এলাকার প্রাকৃতিক পানির জলাধারসহ অসংখ্য গভীর, অগভীর নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত দেড় দশকে পানির সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
উপকূলীয় এ অঞ্চলের গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী ও রমজাননগর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকার বেশিরভাগ খাল ও পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় কোথাও গোসল এবং খাবারের পানি মিলছে না। লোকজন আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ ও নোংরা পুকুরের পানি পান করছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষ প্রচণ্ড গরমে পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়ায় রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
কৈখালী ইউনিয়নের বৈশখালী এলাকার নুরুল হক গাজী বলেন, তীব্র তাপদাহে এলাকার সব পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে।
অন্যদিকে, নলকূপের পানিও লোনা। সরকারি-বেসরকারি যেসব খাবার পানির উৎস ছিল সেগুলো সংস্কার করার অভাবে সংকট বেড়েছে। যা এই এলাকার মানুষের জনজীবন চরম হুমকিতে ফেলেছে।
গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম, আব্দুল কাদের ও রুহুল আমিনসহ বেশ কয়েকজন জানান, তাদের এলাকার পানি লবণাক্ত। সরকারি অনেক জায়গা থাকলেও সরকারি কোনো পুকুর বা জলাধার না থাকায় প্রতিবছর দু-তিন মাস বিশুদ্ধ খাবার পানির কষ্টে জীবন কাটাতে হয় তাদের। এই তীব্র গরমে এলাকায় খাবার পানি ও দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারযোগ্য পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এর একটি স্থায়ী সমাধান চান তারা।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক চিকিৎসক ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, তাপদাহ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশিরভাগ শিশু ও বৃদ্ধের ডায়রিয়া, আমাশয়, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে। এছাড়া গরমে পানি স্বল্পতাসহ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। তাই তীব্র তাপ প্রবাহে শিশু, বৃদ্ধদের খুব জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী হাফিজুর রহমান হাফিজ গ্রীষ্মের তাপদাহ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে উল্লেখ করে বলেন, সরকারি-বেসরকারিভাবে পানির ব্যবস্থা না করলে এখানকার মানুষের বেঁচে থাকা দায়। সেজন্য একটি স্থায়ী সমাধান ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সরকার এবং সব উন্নয়ন সংস্থাকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাই।
তরুণ জলবায়ুকর্মী এসএম শাহিন আলম বলেন, কোনো এলাকায় খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিলে তা শুধু খাওয়ার পানির সমস্যায় আটকে থাকে না। আরও বড় বড় সংকটের কারণ হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি হয়। বিষয়গুলোকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার। সংকটটি সাময়িক নয়, শিগগিরই প্রাকৃতিকভাবে এর সমাধান হবে, তেমন কোনো লক্ষণও নেই।
তিনি বলেন, এই সংকট থেকে এখানকার মানুষকে কীভাবে নিষ্কৃতি দেওয়া যায়, তা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। বর্তমানে বৃষ্টির পানি জলাধারে সংরক্ষণ করে ও পুকুরের পানি ফিল্টারিং করেই মূলত এলাকাবাসী পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেই পানির পরিমাণ খুবই কম। সরকারিভাবে যদি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বড় বড় জলাধার তৈরি করা যায় এবং পানি শোধনের বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, তাহলে তাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, সরকারিভাবে এলাকাবাসীর মধ্যে ট্যাংক সরবরাহ করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা তার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১ হাজার ৯৪৯টি গভীর, ৪৯১টি অগভীর, ৫০০টি এসএসটি ও ৪৪১টি ভিএসএসটি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে আটটি গভীর, ১২৯টি অগভীর, ১৬টি এসএসটি ও ৪৪টি ভিএসএসটি নলকূপ কয়েক বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে।
শুধুমাত্র দুর্যোগকালীন সময়ে সরকারিভাবে দুর্গতদের মধ্যে খাওয়ার পানি বিতরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পানির সমস্যা দূরীকরণে শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএসএফ, আরডব্লিউএইচ (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং), গভীর ও অগভীর নলকূপ, আরও (রিভার্স অসমোসিস), পুকুর, দীঘি, মার (ম্যানেজ একুইফার রিসার্চ) মিলিয়ে প্রায় ৮ হাজার পানির উৎস রয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাব, বন্যায় এলাকায় লবণ পানি ঢুকে যাওয়া, পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে।