প্যাকেটজাত দস্তা-বোরন সারের ৮৪ শতাংশই ভেজাল

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রাজশাহীর একটি সরকারি কৃষি গবেষণা দপ্তরে ২৮৪টি দস্তার নমুনায় ভেজাল মিলেছে ৮৪ শতাংশ এবং মূল উপাদান অনুপস্থিত এমন সার মিলেছে ২৭টিতে। এছাড়া, বোরন সারের নামে প্যাকেটজাত করে বিক্রি হচ্ছে মাটির জন্য ক্ষতিকর শুকনো সোডিয়াম সালফেট। ৫০ শতাংশ ভেজাল মিলেছে জিপসামেও। ভয়াবহ এই জালিয়াতি করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে। যদিও সংস্থাটির দাবি কিছুই জানেন না তারা।

জানা যায়, ২০ শতাংশ বোরন রয়েছে এমন ৫০০ গ্রামের প্যাকেট খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়। দস্তা সার এক কেজির প্যাকেট খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়।

বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রাজশাহীর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরে বিভাগের মোট ৮ জেলা থেকে ৭০০টি বিভিন্ন ধরনের সারের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অন্য কোনো সারের নমুনায় ভেজালের তথ্য তেমন পাওয়া না গেলেও তিনটি সারে উঠে আসে ভেজালের বিভিন্ন মাত্রা। যার মধ্যে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে বোরন ও দস্তা। অনেক নমুনায় মেলেনি সারের মূল উপাদান।

তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলো এই সারগুলো আমদানি করছে কিংবা দেশে প্যাকেজিং করে বিপণন করছে তারাই এ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। দাম বেশি হওয়ায় নিম্নমানের পণ্য প্যাকেটজাত করে কৃষকের সঙ্গে এই প্রতারণা করছে তারা। যদিও এই অনিয়ম ধরার জন্য মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রাজশাহীর এই গবেষণাগার থেকে প্রাপ্ত তথ্য আসলে কতটুকু সত্য তা মাঠপর্যায়ে যাচাই করা জরুরি।

চারঘাট উপজেলার সুলেখা বেগম জমিতে সার প্রয়োগের পর আশানুরূপ ফলন না পাওয়ায় জমির মাটি পরীক্ষা করতে নিয়ে আসেন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রাজশাহীতে। এখানে এসে তিনি সারের ভেজালের বিষয়টি জানতে পারেন।

পবা উপজেলার দামকুড়া এলাকার কৃষক সাইদুর ও ডলার বলেন, বর্তমানে জমিতে সার ব্যবহারের পর তেমন একটা কার্যকারিতা নেই। ফলে মাটির উর্বরতা কমার পাশাপাশি উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়া এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।

তারা বলেন, অন্য পণ্যের মতো ডিলার পয়েন্ট থেকে সার পরীক্ষা করে কেনার কোনো সুযোগ নেই। ফলে জমিতে প্রয়োগের পূর্বে জানা যায় না যে সারটির গুণগত মান ঠিক আছে কি না?

কৃষকদের অভিযোগ বিশ্লেষণ করেন স্থানীয় সার ডিলার নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, কয়েকটি কোম্পানির সার বাদে অধিকাংশ প্যাকেটজাত দস্তা ও বোরন সার এখন ভেজালে সয়লাব। কৃষকরা তুলনামূলক কম দামে সার পেতে চেষ্টা করেন। কম দামে সার কিনতে গিয়েই প্রতারণার শিকার হন। এখন প্রায় ঘরে ঘরে এই সার প্যাকেজিং কারখানা গড়ে উঠেছে। যেখানে কৃষকের ফলন বৃদ্ধির সারের চেয়ে কৃষককে ধ্বংস করার সারই বেশির ভাগ তৈরি হচ্ছে।

জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে চলতি বছরের জুন মাসে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ‘আরামকো ফ্রেশ বোরন’ নামে একটি কারখানা প্যাকেটজাত বোরন সার তৈরি করছে। কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ফ্রেশ বোরন সার নামে যে প্যাকেট তারা করছে তাতে ভরে দেয়া হচ্ছে ১০ বছরের পুরানো সোডিয়াম সালফেট। পাশে ফেলে রাখা অন্তত ১০টি সোডিয়াম সালফেটের বস্তা পাওয়া যায়। যে বস্তার গায়ে লেখা চীন থেকে আমদানিকৃত। যা তৈরি হয়েছে ২০১৪ সালে। একই ভাবে এ কারখানায় ভিন্ন ভিন্ন রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে দস্তা, জিপসামসহ মোট ৮টি সার প্যাকেটজাত ও সরবরাহ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কারখানাটিতে কর্মরত তিন জন শ্রমিক বলেন, সারগুলোতে কী উপাদান দেয়া হচ্ছে তা তারা জানেন না। তাদের কাজ বস্তা থেকে ঢেলে প্যাকেট তৈরি ও বাজারে কার্টনগুলো সরবরাহ করা।

জানা যায়, শুধু পবা উপজেলা নয় দামকুড়া, কাঁকন হাট, কদম শহর, গোদাগাড়ী উপজেলাসহ নানা স্থানে এমন চক্র ভুয়া সার তৈরির ফাঁদ পেতেছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম হামিদুল হক বলেন, সোডিয়াম সালফেট কখনও বোরনের পরিপূরক হতে পারে না। ১০ বছর পূর্বের সোডিয়াম সালফেট অনেক কম মূল্যে ইমপোর্ট করে তারা বোরন নামে প্যাকেটজাত করে কৃষককে ধোঁকা দিচ্ছে। সোডিয়াম সালফেট মূলত গার্মেন্টস সেক্টর ও কাগজ শিল্পে ব্যবহার হয়।

তিনি বলেন, ঠিক একই ভাবে দস্তা, জিপসামসহ অন্য সারের ক্ষেত্রেও এই পরিবেশকদের অনেকেই প্যাকেটে সঠিক উপাদান দিচ্ছেন না। এটা কৃষকদের উৎপাদন কমার পাশাপাশি দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। যারা এদের কারখানার রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছেন তাদের উচিত কৃষকের মাঝে তারা কী ধরনের সার প্যাকেট করে বিতরণ করছে তা সঠিক ভাবে তদারকি করা।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ড. মোতালেব হোসেন বলেন, সম্প্রতি সার প্রতারণার বিষয়টি তাদের সভায় উঠে এসেছে। খোঁজখবর নিতে ঊর্ধ্বতনদের বলা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে এই কাজগুলো কিছু প্রতিষ্ঠান করছে।

এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোছা. উম্মে ছালমা বলেন, সার ভেজালের বিষয়টি তিনি জানেন না। অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সারাদেশে কৃষি অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের সার আমদানিকারকের নিবন্ধন হালনাগাদ রয়েছে ৪ হাজার ৫৮৩টি। আর পরিবেশক নিবন্ধন রয়েছে ১ হাজার ৭৪৪টি।

তবে সূত্র বলছে, মাঠ পর্যায়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের দ্বারা অসাধু ব্যবসায়ীরা এই অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।