জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকৃত এয়ারলাইন্সগুলো। আর অতিরিক্ত এ ভাড়া বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন বিমানে চলাচলকারী যাত্রীরা।
তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে ফুয়েলের দাম বৃদ্ধির কারণেই দেশিয় বাজারে দাম বাড়াতে হচ্ছে।
জানা যায়, গত দুই বছরে অভ্যন্তরীণ বিমানের ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এতে নাভিশ্বাস সাধারণ যাত্রীদের। বাধ্য হয়ে সড়ক পথ বেছে নিচ্ছে অনেকেই। আর এভাবে চলতে থাকলে দেশের বিমান পরিবহন সেবা হুমকির মুখে পড়বে বলেও আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) তথ্য মতে, উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জ্বালানির দাম দুই বছর আগে ছিল প্রতি লিটার ৪৬ টাকা। এখন সরকার নির্ধারিত দাম ১০৬ টাকা। শুধু গত দেড় বছরেই দাম বেড়েছে ১২২ শতাংশ। ২০২১ সালে দেশে ফুয়েলের চাহিদা ছিল তিন লক্ষ ১৯ হাজার ৭০৮ মেট্রিক টন। যার পুরোটাই আমদানি করতে হয়েছে।
তথ্যমতে, দেশে সকল জ্বালানীর দাম নির্ধারণ করে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বিপিসি। আর এটির বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল লিমিটেড। এছাড়াও অন্যান্য জ্বালানি বিপণনে রয়েছে মেঘনা অয়েল, যমুনা অয়েল লিমিটেডসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ফুয়েলের দাম লিটার প্রতি ১ দশমিক শূন্য ৪ ডলার বা ১২৬ টাকা। কিন্তু সরকার গত ১৭ মে ফুয়েলে ভর্তুকি দিয়ে অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য ১০৬ টাকা লিটার এবং আন্তর্জাতিক রুটের জন্য তিন টাকা বাড়িয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে তালিকা প্রকাশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলে দেশেও দাম কমা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বিপিসির কর্মকর্তারা।
বিপিসির তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে প্রতি লিটার ফুয়েলের দাম ছিল ৭৩ টাকা। কিন্তু ০৯ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে ৮০ টাকা করা হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে ০৮ মার্চ সাত টাকা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা এবং ০৭ ফেব্রুয়ারি ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়। সর্বশেষ ১৫ মে আরও ছয় টাকা বাড়িয়ে ১০৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এ বিষয়ে বিপিসির অপারেশন ও পরিকল্পনা শাখার পরিচালক খালেদ আহমেদ (অতিরিক্ত সচিব) ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশেও দাম বেড়েছে। তবে দাম আর বাড়বে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও দাম কমে যাবে।’
একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে অন্যদিকে বাজেটের পর সাধারণত পণ্যের দাম বেড়ে যায়, সব মিলিয়ে বাজেট পরবর্তীতে ফুয়েলের দাম আরও বাড়বে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের ব্যাপার।’
এক প্রশ্নের জবাবে খালেদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা জ্বালানিতে ভর্তুকির বিষয়ে সুপারিশ করি না। বিমান ভাড়া বাড়ানো-কমানোর দায়িত্ব বিমান কর্তৃপক্ষের। আমরা শুধু বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করি।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিমানে যাতায়াতকারী যাত্রী হেলাল মাহমুদ ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায়িক কারণে প্রায়ই চট্টগ্রাম যেতে হয়। কিন্তু বিমানে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বিপদে পড়ে যাচ্ছি। যাওয়া আসায় যদি ১০-১২ হাজার টাকা লেগে যায়, তাহলে বাধ্য হয়েই আকাশ পথে যাতায়াত বন্ধ করে দিতে হবে।’
রাজধানীর বেসরকারি কলেজের ছাত্র রাতুল হাসান বলেন, ‘নভোএয়ারে কক্সবাজার এসেছি, ভাড়া নিয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু আমার বন্ধুরা বাসে এসেছে মাত্র এক হাজার ২০০ টাকায়। বিমানের ভাড়া অতিরিক্ত হওয়ায় বাসে ঢাকায় ফিরবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৩০ মিনিট পর বিমান ছেড়েছিল। তবে আসতে ঘন্টাখানেক লেগেছিল।’
পরিবহন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বর্তমানে ঢাকা থেকে যশোরে এসি বাস ভাড়া এক হাজার তিনশ’ টাকা এবং নন এসি ৫৫০ টাকা। আর ঢাকা-খুলনা রুটে এসি বাস ভাড়া এক হাজার চারশ’ এবং নন এসি ৬৫০ টাকা। এছাড়াও চট্টগ্রামে এসি বাস ভাড়া এক হাজার দুইশ’ থেকে এক হাজার চারশ’ টাকা এবং কক্সবাজারে এক হাজার পাঁচশ’ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এছাড়াও সিলেট, রাজশাহীতে নেয়া হচ্ছে এসি এক হাজার দুইশ’ থেকে এক হাজার চারশ’ টাকা এবং ননএসি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা।
করোনার আগে যখন ফুয়েলের দাম ৪৬ টাকা ছিল তখন ঢাকা-কক্সবাজার রুটের সর্বনিম্ন বিমান ভাড়া ছিল তিন হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার আটশ টাকা। একই ভাবে ঢাকা-যশোর বা ঢাকা-সৈয়দপুর রুটের ভাড়া ছিল দুই হাজার সাতশ টাকা, তবে এখন বেড়ে হয়েছে চার হাজার আটশ টাকা। এছাড়াও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীর ভাড়া ছিল সর্বনিম্ন দুই হাজার সাতশ’ টাকা। অথচ বর্তমানে একই রুটের সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। তবে ভিআইপিদের ভাড়া ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে সোহাগ পরিবহনের সেলস ম্যানেজার মো. রাকিব ভোক্তকণ্ঠকে বলেন, ‘ডিজেলের দাম বাড়ার পর বাসের ভাড়া বেড়েছিল। তবে গত চার মাস যাবৎ ভাড়া অপরিবর্তিত রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা এবং কক্সবাজারে সাত ঘন্টার মত সময় লাগে। তবে যশোর বা খুলনার রুটের বিষয়টি নির্ভর করে ফেরি ঘাটের যানজটের উপর।’
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের তোপখানা কর্পোরেট শাখার এক্সিকিউটিভ মো. মেহেদি হাসান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা-যশোর রুটের বিমান ভাড়া বর্তমানে চার হাজার ৫০০ টাকা এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের ভাড়া পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। জ্বালানির দাম বাড়লেও এ বছরে ভাড়া বাড়েনি। তবে মাস দেড়েক আগে কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভাড়া কমানো হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাড়া যে শুধু জ্বালানির উপর নির্ভর করে বাড়ানো হয় এমন নয়, এটা মার্কেটিংসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
ভাড়া বাড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মেহেদি হাসান বলেন, ‘এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানেন।’
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘করোনা মহামারির পর আলোর পথ দেখা যাচ্ছিল এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম সেক্টরে। কিন্তু সেই পথকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলতে চেষ্টা করছে জেট ফুয়েলের দাম। বিপিসি কখনো লোকসানকে পুষিয়ে নিতে দাম বৃদ্ধি করে আবার কখনো যুদ্ধের অজুহাতে বৃদ্ধি করে। এভাবে চলতে থাকলে শেষ হয়ে যাবে এভিয়েশন এবং ট্যুরিজম খাত।’