ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের যত আয়, তার চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়ছে। ফলে চলতি আয়ের ভারসাম্যে যে ঘাটতি, তা দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেন নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।
আর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে দুভাবে। বৈদেশিক লেনদেনে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে অনেক বেশি। এতে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম, মূল্যমান হারাচ্ছে টাকা। এর ফলে রপ্তানিকারকেরা কিছুটা লাভবান হলেও আমদানি মূল্য বাড়ছে অনেক বেশি। যাঁরা কাঁচামাল বা মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতেন, তাঁদের সব হিসাব উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। সবারই খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী এখন বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির চাপ ঠেকানো। এটিই এখন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশেও আমদানি ব্যয় ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চাপকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে এক লাফে ভোজ্যতেলের দর বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৩৮ টাকা। বাড়ছে বেশির ভাগ পণ্যের বাজারদর। বিশেষ করে যেসব পণ্যে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর, সেসব পণ্য নিয়েই বিপদ বেশি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকেও এখন ভাবতে হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বুধবার সরকারের ব্যয় কমানোর কথা বলেছেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ ও কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। আমদানিতেও লাগাম টানার কথা বলেছে সরকার। এরই মধ্যে দামি গাড়ি ও নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চোখের দেখায় জিডিপি, পুরোনো হিসাবে মূল্যস্ফীতি
দুই দিন আগে সরকার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সাময়িক প্রাক্কলন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হচ্ছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার, এবার তা হচ্ছে ২ হাজার ৮২৫ ডলার।
জিডিপির হিসাব নিয়ে বিতর্ক কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। তবে গতকাল অর্থমন্ত্রী বিতর্ক উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘চারদিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী।’ আর আগের দিন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম শামসুল আলম বলেছিলেন, ‘মানুষের আয় বেড়েছে, তারা মনের আনন্দে বাজার করছে।’
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে
মানুষের মনের আনন্দ আর চারদিকে তাকিয়ে দেখে জিডিপির হিসাব করা হলেও মূল্যস্ফীতির হিসাব সরকারই করছে সেই ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে। ফলে বর্তমানের ভোক্তাদের কেনাকাটা, চাহিদা ও রুচির কোনো চিত্র মূল্যস্ফীতিতে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরোনো ভিত্তি বছরকে ধরে রাখার কারণে সরকার মূল্যস্ফীতি কম দেখাতে পারছে। সরকারের হিসাবে এখন দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। তবে জাতীয় মূল্যস্ফীতি কাগজে–কলমে যা–ই হোক, সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে অনেক বেশি। মানুষ কষ্টে আছে, কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানে তার প্রমাণ নেই।
বিপদ আন্তর্জাতিক লেনদেনে
রপ্তানি খাতে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এর পুরো আয় বাংলাদেশ পাচ্ছে না। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, স্বাভাবিক সময়ে পোশাক খাতের মূল্য সংযোজনের হার ৫৮ শতাংশের কিছু বেশি। এখন বিশ্বব্যাপী সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। ফলে খোলা চোখে রপ্তানি আয়ে যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত আয় এর চেয়ে কম। অন্য দিকে আমদানি ব্যয় সব হিসাবকে পাল্টে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে এর আগে পুরো এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৬ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, গত অর্থবছরে। এবার ৯ মাসেই এই ব্যয় হয়ে গেছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি ডলারে। এখন মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।
অন্যদিকে কোভিডের দুই বছরে প্রবাসী আয়ে যে স্বস্তি ছিল, চলতি অর্থবছরে তা উধাও হয়ে গেছে। এবার প্রবৃদ্ধি পুরোটাই ঋণাত্মক, ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। বিপুল আমদানি ব্যয় ও নিম্নমুখী প্রবাসী আয়ের প্রভাবে অর্থবছরের ৯ মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০৭ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল সাড়ে ৫৫ কোটি ডলার। দেশের ইতিহাসে চলতি আয়ে এত বড় ঘাটতি আর কখনো হয়নি। চলতি হিসাবে ঘাটতি মানেই সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম, ব্যয় অনেক বেশি। আয় ও ব্যয়ের এই ভারসাম্যহীনতাই ডলারের দাম বাড়াচ্ছে।
সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ
বিশ্বের সব দেশই পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে মূল কাজ ধরে নিয়ে কৌশল ঠিক করছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ অর্থ সরবরাহ খানিকটা কমিয়ে আনতে নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ এমনিতেই কম। ফলে সুদহার বাড়ানোর কথা ভাবতে পারছে না। বিনিয়োগের অন্যান্য বাধাও দূর করতে পারছে না। এর মধ্যে আবার আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। আবার সব পণ্য ঠিকমতো পাওয়াও যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদনও বিঘ্নিত হচ্ছে।
এ অবস্থায় কী করণীয়, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, বর্তমানে অর্থনীতিতে বহির্বাণিজ্যে ঘাটতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই ঘাটতির কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, সার, শিল্পপণ্য ও যন্ত্রপাতি, ভোজ্যতেল, নির্মাণসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আবার পণ্য আমদানিতে জাহাজভাড়া, বিমাসহ সার্বিক পরিবহন খরচও বেড়েছে। এতে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বেড়েছে, যা ডলারে পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে ডলার আহরণের অন্যতম বড় উৎস প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে গেছে। ফলে রপ্তানি ভালো হওয়া সত্ত্বেও সার্বিকভাবে ঘাটতি বেড়েছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু জোগান কম। ফলে মুদ্রাবাজারে বিশেষ করে খোলাবাজারে বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে রিজার্ভ ফুরিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের জোগান দিতে গিয়ে মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি বিল পরিশোধের রিজার্ভ আছে। পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতিতে একধরনের উভয়সংকটে পড়েছে সরকার। হুকুম দিয়ে নয়, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মুদ্রা বিনিময় হার সমন্বয় করা হলে ডলারের দাম কিছুটা বাড়বে, যা বিলাসপণ্য ও কম প্রয়োজনীয় পণ্য নিরুৎসাহিত হবে। আবার ডলারের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও তা করা উচিত। কারণ, ৬-৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপ গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর পড়বে। সরকার তাদের জন্য নগদ সহায়তা প্রদানসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ভাতা বাড়াতে পারে।