ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশের ৭৫ শতাংশ সেচ কার্যক্রম এখনো ডিজেলনির্ভর। কৃষি কাজে বছরে নয় লাখ ৭২ হাজার টন ডিজেল ব্যবহার হয়। এতে কৃষকের খরচ হয় সাত হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। নতুন করে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। তাতে এখন ব্যয় হবে ১১ হাজার ৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষকের ব্যয় বাড়ছে তিন হাজার ৩০৪ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশই ডিজেল। পরিবহনের পরে সবচেয়ে বেশি ডিজেলের ব্যবহার হয় কৃষিখাতে। ডিজেলের দাম সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ায় বড় প্রভাব পড়বে সার্বিক উৎপাদনে। ব্যয় বাড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষকের মধ্যে। আরও ভঙ্গুর হবে খাদ্যনিরাপত্তা।
একই কথা বলছেন কৃষকরাও। নওগাঁ হোগলবাড়ির কৃষক সুধা মিয়া বলেন, ‘প্রতি বিঘা জমিতে স্যালো মেশিনে পানির খরচ হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। আগে একবার সেচ দেওয়ার জন্য ৩শ টাকা নিতো। শনিবার থেকে সেটা বিঘায় ৫০০ টাকা হয়েছে। এখন খরচ হবে পাঁচ হাজারের বেশি।’
‘যে খরা যাচ্ছে, আমনের খরচ সবমিলে দ্বিগুণ। এর মধ্যে সার ও সেচ খরচ বেড়েছে। ডিজেলের জন্য ফসল মাড়াই খরচও বেশি হবে। বোরো মৌসুম পুরোপুরি সেচনির্ভর। সেজন্য আর বোরো ধান চাষ করা যাবে না। আমনেই লস হবে। সেচ কম লাগে এমন ফসল করার চিন্তা করছি।’
যশোরের কৃষক সুজাউল হক বলেন, ‘আমনের থেকে ইরি-বোরোতে সেচ লাগে অনেক বেশি। ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ ও মাড়াই খরচের জন্য অনেকে বোরো চাষ করবে না।’
চলতি মৌসুমে খরার কারণে এবছর সেচ খুব বেশি প্রয়োজন হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়েও দেশের বরেন্দ্র এলাকায় তুলনামূলক সেচ বেশি লাগে। ওই এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, ডিপ টিউবওয়েল থেকে সেচ দিতে কৃষকের খরচ হতো বিঘাপ্রতি ১৬শ থেকে দুই হাজার টাকা। ডিজেলের দাম প্রথম দফায় বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করার পরে সে খরচ ২২শ টাকায় দাঁড়ায়। এখন নতুন করে সাড়ে ৪২ শতাংশ দাম বাড়ার ফলে খরচ পাঁচ হাজার টাকায় ঠেকবে। বোরোতে আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার (বিএডিসি) হিসাবে, ৭৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে সেচ দেন। কৃষিখাতে গত বছর ডিজেলের চাহিদা ছিল ৯ লাখ ৭২ হাজার টন। এর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ টন প্রয়োজন হয় বোরো মৌসুমে।
তথ্য বলছে, শুধু সেচের কারণে এখন কৃষির ব্যয় বাড়ছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া যন্ত্রের মাধ্যমে মাড়াই খরচ বাড়বে একই হারে। সঙ্গে বাড়বে পরিবহন খরচও। অন্যদিকে গত সপ্তাহে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোয় প্রতি বিঘা (বোরো ও আমন) আবাদে ইউরিয়া সারে খরচ বাড়ছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। বর্তমানে কৃষক বছরে ইউরিয়া সারে খরচ করে ৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা গিয়ে দাঁড়াবে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকায়।
এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে জয়পুরহাট কালাই উপজেলার কৃষক সিদ্দিক মিয়া বলেন, এমন অবস্থায় চাষাবাদ ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ এসব খরচ বাড়লেও কৃষক নায্যমূল্য পাবে না। নিজের সম্পদ বেঁচে কৃষিকাজ করা সম্ভব নয়। কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে অনেক কৃষক বাড়তি ব্যয়ে ফসল উৎপাদন করতে পারবেন না। ডিজেলের এ মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাত্তার জন্য হুমকি। খাদ্যের আমদানি আরও বাড়বে। যে ভর্তুকি কমাতে তেলের দাম বাড়ানো হলো সে অর্থ দিয়ে তখন চড়া দামে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে।’
‘এবার আমন মৌসুমে বৃষ্টি কম থাকায় অনেকেই সেচের জন্য বাড়তি খরচ করছে। অন্যদিকে বোরো মৌসুমের প্রায় ৭৫ শতাংশ জমিতেই ডিজেলচালিত সেচপাম্প দিয়ে সেচ দেওয়া হয়। সেখানে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি একটা বড় সমস্যা করবে। সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয় বোরোতে, এ চাষে অনীহা বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘খাদ্যের জোগান দিতে এখন যেখানে ১০-১৫ লাখ টন চাল আমদানি করি। তখন ২০-২৫ লাখ টন এনে খাওয়াতে হবে। সেখানে বাড়তি টাকা যাবে সরকারের। আর সাধারণ মানুষের খরচ বাড়ার চাপতো রয়েছেই।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন ঠিক রাখা ও কৃষককে বাঁচাতে হলে এখন নগদ ভর্তুকি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।’
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এখনই কৃষকের ভর্তুকি দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।
কৃষি সচিব সায়েদুর রহমান বলেন, বোরো আবাদের জন্য হাতে সময় রয়েছে। প্রয়োজনে ভর্তুকির বিষয়টি প্রস্তাব করা হবে।
এদিকে, সেচের পাশাপাশি পাওয়ার টিলারে হালচাষ, মাড়াই ও পরিবহনখাতসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। সেজন্য ডিজেলের চাহিদার পরিমাণ সেচকাজের চেয়ে কিছুটা কম। সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও মোট চাহিদার প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ ব্যয় হয় এ সেচকাজে।
বিএডিসির তথ্য আরও বলছে, দেশে মোট কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৯৭ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে সেচযন্ত্রের আওতায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪০ জন। শুধু ডিজেল সেচভুক্ত ১ কোটি ২৩ লাখ কৃষক রয়েছেন। বাকিরা বিদ্যুৎচালিত সেচভুক্ত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবিঘা জমিতে চাষাবাদের জন্য ২০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন। লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এবছর কৃষকের বিঘাপ্রতি প্রায় ৫শ টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। জাগো নিউজ।