ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: এক সময় সিরামিক ও কাচকে বলা হতো আমদানিকৃত পণ্য। গত ২০ বছরে সেই চিত্র বদলেছে আমূল। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও দেশিয় উদ্যোক্তাদের কল্যাণে এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে সিরামিক। চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও হচ্ছে বিশ্বের প্রায় ৫০ দেশে। ক্রমেই বড় হচ্ছে এই শিল্পের বাজার। বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে দেশিয় কোম্পানিগুলো। ফলে কমছে আমদানি (বর্তমানে আমদানি বন্ধ রয়েছে)। তবে গ্যাস সংকটের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এ খাতের রপ্তানি লক্ষ্য।
জানা যায়, সিরামিকের আন্তর্জাতিক বাজার প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য বর্তমানে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ ৫০টির বেশি দেশে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকার সিরামিক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশেই উৎপাদন হচ্ছে ৮৫ শতাংশ সিরামিক। সরকারের আরও কিছু পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশিয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আরও বেশি সিরামিক পণ্য রপ্তানি সম্ভব।
জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সিরামিক খাতে রপ্তানি আয় হয় ছয় কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৮৭ কোটি টাকা। বর্তমানে এটা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরামিক রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশে বাংলাদেশের টেবিলওয়্যার, ফ্লোর টাইলস, স্যানিটারি, কমোড ও বেসিনের অনেক চাহিদা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সাত-আট কোটি ডলারের সিরামিক পণ্য রপ্তানি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানির টার্গেট ১০ কোটি ডলার বা এক হাজার কোটি টাকা। তবে বর্তমানে গ্যাস সংকটের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সিরামিক কারখানায় পণ্য প্রস্তুতে চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকতে হয়। সেই হিসেবে এই শিল্পে গ্যাস একটি অন্যতম কাঁচামাল। পণ্য উৎপাদনে ১০-১১ শতাংশ খরচই হয় গ্যাসের পেছনে। দিনে অনেক সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। চুল্লি বন্ধ করলে আবারও গরম করতে গ্যাস বেশি লাগে। গ্যাসের প্রেসার দরকার হয়, কারণ চুল্লি রাখতে হয় সাড়ে ১১ থেকে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তাপমাত্রা কমে গেলে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
সিরামিক শিল্পে দিনে গ্যাস থাকে না। সন্ধ্যার পর গ্যাস আসে, থাকে সকাল পর্যন্ত। গ্যাস সংকটের কারণে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন করতে না পারায় অনেক কারখানায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিসিএমইএ) সূত্র জানায়, দেশে সিরামিক কারখানার সংখ্যা ৬৬টি। এসব কারখানায় যেমন সস্তা দামের পণ্য তৈরি হয়, তেমনি মধ্যম দামের মানসম্মত পণ্যও তৈরি হয়। কারখানাগুলোর মধ্যে ২৮টি টাইলসের, ২০টি তৈজসপত্রের ও ১৮টি স্যানিটারিওয়্যারের। নতুন আরও চার-পাঁচটি কারখানা আসছে, যারা দু-এক বছরের মধ্যেই উৎপাদনে যাবে।
বিসিএমইএ আরও জানায়, তৈজসপত্র, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার সিরামিকের উপখাত- এসব পণ্য উৎপাদনে ৭০টি কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে ২০টি তৈজসপত্র, ৩২টি টাইলস ও ১৮টি স্যানিটারিওয়্যারের কারখানা। বাংলাদেশে সিরামিক পণ্যের বাজার সাত হাজার ৩৬৮ কোটি টাকার। এর মধ্যে টাইলসের বাজারই পাঁচ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকার। তৈজসপত্র ও স্যানিটারিওয়্যারের চেয়ে বাজার কয়েকগুণ বড় হওয়ায় গত বছর টাইলসে আট হাজার ৩২৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ফলে দেশে টাইলসের বাজার প্রতিদিনই বড় হচ্ছে। শুধু শহর নয়, গ্রামেও উন্নয়নের ছোঁয়া।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছরে সাত-আট কোটি ডলারের সিরামিক পণ্য রপ্তানি করেছি। সামনে এটা বেড়ে ১০ কোটি ডলার হবে। কিন্তু গ্যাস সংকট চরমে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এক সময় শতভাগ টাইলস বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিমুখী একটি শিল্পে রূপ নিয়েছে, অথচ গ্যাস সংকটে এই শিল্প এখন হুমকির মুখে। এভাবে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে দেশিয় উদ্যোক্তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে। সিরামিক পণ্য উৎপাদনের সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেই বিবেচনায় সিরামিকশিল্পের ভবিষ্যৎ গ্যাস ও বিদ্যুতের দামের ওপর নির্ভর করছে। তাই গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি থেকে সিরামিক খাতকে বাইরে রাখতে আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে এ শিল্পে যেন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
দেশে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কাচ ও সিরামিক উৎপাদন করা হয়। আমদানি করা হয় বাকি ১০ শতাংশ। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ আকিজ, আবুল খায়ের, ডিবিএল, শেলটেকসহ আরও অনেক কোম্পানি সম্প্রতি সিরামিকে বিনিয়োগে এসেছে। নতুন করে জেবি, তুষার, বিএইচএল, মেঘনা গ্রুপসহ ১০-১২টি কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। শুধু দেশি নয়, বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে। সিবিসি, নিউ জং ইয়ান, ফু-ওয়াং, আরএকে ও চায়না-বাংলাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিনিয়োগ আছে। ফলে কমেছে আমদানি। দেশে কাচ ও সিরামিক শিল্পের প্রসার ঘটেছে। পাশাপাশি বেড়েছে আমদানি ট্যাক্স। বিগত কয়েক মাস পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে কাচ ও সিরামিক আমদানি।
বাংলাদেশ সিরামিক অ্যান্ড গ্লাসওয়্যার ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ কবির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে সিরামিক ও গ্লাস ইমপোর্ট লিগালি বন্ধ। বলা যায়, কাচ-সিরামিকে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগে চায়না থেকে ইমপোর্ট হতো। কিন্তু বর্তমানে এটা বন্ধ আছে। চায়না থেকে আমদানিও বন্ধ রয়েছে।
কেন বন্ধ রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে সিরামিক ও গ্লাস শিল্পের প্রসারে আমদানি ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। ট্যাক্স ১৬০ শতাংশ। ভ্যালু অ্যাডেডও কমেছে।
সিরামিক ও কাচ শিল্প সম্প্রসারণে সরকারের ব্যয় সাড়ে ৪১ কোটি টাকা
বালুসহ নানান দেশিয় কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কাচ ও সিরামিক ক্ষেত্রের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকার। এতে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও দেশে রপ্তানিযোগ্য বা আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনের জন্য শিল্প স্থাপনে করা হয় সহায়তা। এর মাধ্যমে সিরামিক শিল্পে ব্যবহারের জন্য জ্বালানি সাশ্রয়ী পদ্ধতির ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প ও গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) কাচ ও সিরামিক গবেষণা এবং পরীক্ষণ ইনস্টিটিউট (আইজিসিআরটি) শক্তিশালীকরণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৩৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় জুলাই ২০১৮ সালে, কাজ শুরু শেষ হওয়ার কথা জুন ২০২১ সালে। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৪১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২২ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই মেয়াদেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের সুফলও মিলেছে। ফলে কাচ ও সিরামিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে দেশ। পাশাপাশি কাচ ও সিরামিক বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
প্রকল্পের পরিচালক ড. শিরীন আক্তার জাহান বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। দেশিয় কাঁচামাল ব্যবহার করে কাচ ও সিরামিক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। আমাদের ইনস্টিটিউট শক্তিশালী করা হয়েছে। জোরদার হয়েছে কাচ ও সিরামিক গবেষণা রিসার্চ। এক্সপোর্টের আগে কিছু চাহিদা থাকে যেমন টেস্টিং করা, এটাও শক্তিশালী করা হচ্ছে। ফলে বলা যায় কাচ ও সিরামিক শিল্পের প্রসার ঘটেছে। এখন দেশ কাচ ও সিরামিক শিল্পে অনেক এগিয়ে গেছে। জাগো নিউজ।