ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা রোধে করে জাতীয়ভাবে উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ কারণে জাতীয় বাজেটে এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সে লক্ষ্যে আসছে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করতে হয়। অথচ রাইস ব্রান অয়েল কিংবা সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারলে এ নির্ভরতা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে পরিশোধিত ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ লাখ ৭৬ হাজার টন। যার কাঁচামাল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর।
ভোজ্যতেল উৎপাদনে আমদানি করা সয়াবিন ও পামের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ টন। যথাযথ উদ্যোগ ও সরকারের বিশেষ নজর থাকলে স্থানীয়ভাবে চাহিদার প্রায় ৩৬ শতাংশ জোগান দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোজ্যতেল উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। আসছে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এজন্য বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাইস ব্রান ওয়েল কিংবা সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়াতে থাকছে বিশেষ নজর। এছাড়া ভালো মানের বীজ সরবরাহ কিংবা মাঠপর্যায়ের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ারও চিন্তাভাবনা থাকছে
অন্যদিকে, বিভিন্ন রাইস ব্রান অয়েলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় প্রায় দুই লাখ টন সরিষার তেল। এগুলো পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেল নিয়ে বড় সংকটের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। বাড়তি দামে বিক্রির পাশাপাশি একপর্যায়ে বাজার থেকে পণ্যটি উধাও হয়ে যায়। ভোজ্যতেল পেতে ক্রেতাদের দোকান থেকে দোকানে ছুটতে হয়। বাধ্য হয়ে মাঠে নামে প্রশাসন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখন মজুত করা ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হচ্ছে। মূলত অধিক মুনাফার আশায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অনৈতিক এ কাজ করছেন।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোজ্যতেল উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। আসছে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এজন্য বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাইস ব্রান ওয়েল কিংবা সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়াতে থাকছে বিশেষ নজর। এছাড়া ভালো মানের বীজ সরবরাহ কিংবা মাঠপর্যায়ের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ারও চিন্তাভাবনা থাকছে।
পুরোপুরি না হলেও আপাতত নির্ভরতা কমিয়ে অন্তত ৫০ শতাংশ দেশীয় উৎস থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। এ কারণে আগামী বাজেটে সরিষা চাষ ও রাইস ব্রান ওয়েলের কাঁচামাল ধানের তুষ বা কুঁড়া সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্যাকেজের ঘোষণা আসতে পারে বাজেটে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট-সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে ভোজ্যতেল নিয়ে তেলেসমাতি চলছে। অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব। ফলে আমাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বিকল্প নেই।
পুরোপুরি না হলেও আপাতত নির্ভরতা কমিয়ে অন্তত ৫০ শতাংশ দেশীয় উৎস থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। এ কারণে আগামী বাজেটে সরিষা চাষ ও রাইস ব্রান ওয়েলের কাঁচামাল ধানের তুষ বা কুঁড়া সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্যাকেজের ঘোষণা আসতে পারে বাজেটে। এছাড়া উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা, মানসম্মত বীজ সরবরাহ ও উৎপাদনে বিশেষ প্রণোদনা বা ভর্তুকির জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকবে। যাতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে খুচরাপর্যায়ে দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখা যায়। পাশাপাশি ভোক্তাদের এসব তেলের ব্যবহার বাড়াতে উৎসাহমূলক প্রচারণারও ব্যবস্থা করা হবে। অর্থাৎ একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ছাপ থাকবে আসছে বাজেটে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। যেখানে দুই লাখ টন উৎপাদন হয় স্থানীয়ভাবে। বাকি ১৮ লাখ টন সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানি হয় ভোজ্যতেল হিসেবে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আসে পাম অয়েল। যার ৮০ শতাংশের জোগান দেয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশে অয়েল সিড হিসেবে সরিষা, গ্রাউন্ডনাট, তিল, সয়াবিন ও সানফ্লাওয়ারের চাষ হয়।
দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থান ছাড়া অটো রাইস মিল নেই। ফলে এখনও অর্ধেকের বেশি ধান ভাঙানো হয় স্থানীয়পর্যায়ে। সেখান থেকে যথাযথ কুঁড়া সংগ্রহ করা যায় না, গেলেও মানসম্মত হয় না। এছাড়া কুঁড়ার বড় একটি অংশ এখন পোল্ট্রি ফার্ম ও মাছের খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পরিশোধিত ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট উৎপাদনের ক্ষমতা ৫০ লাখ ৭৬ হাজার টন। যার কাঁচামাল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। আমদানি করা সয়াবিন ও পামের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ টন। যার প্রায় ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
এছাড়া বিভিন্ন রাইস ব্রান অয়েল কোম্পানির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে প্রায় দুই লাখ টন সরিষার তেল উৎপাদিত হয়। যা পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরবরাহ হয়।
সাধারণত ছয় থেকে সাড়ে ছয় কেজি ধনের কুঁড়া থেকে এক কেজি রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন হয়। ধান থেকে চাল তৈরি করলে সাত থেকে আট শতাংশ কুঁড়া পাওয়া যায়।
ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে আড়াই লাখ টন রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন সক্ষমতার ১৫টি কারখানা স্থাপিত হয়। এ পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য ১৩ লাখ টন রাইস ব্রান (ধানের কুঁড়া) দরকার। দেশের ভেতরে কুঁড়া উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ৩৬ লাখ টন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায়। অথচ কোম্পানিগুলো প্রায় সাড়ে চার লাখ টন কুঁড়ার সরবরাহ পায়। যে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন থেকে সরে এসেছে।
ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে আমরা অতিরিক্ত পরিমাণ আমদানিনির্ভর। ফলে বিশ্ববাজারের কাছে আমরা জিম্মি বলতে পারেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাজেটে এমন সব পরিকল্পনা থাকা উচিত যাতে দেশীয় উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন। যেমন- উন্নত মানের বীজ সরবরাহ কিংবা বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা। এছাড়া গবেষণায় জোর দেওয়া যেতে পারে
কারণ হিসেবে খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থান ছাড়া অটো রাইস মিল নেই। ফলে এখনও অর্ধেকের বেশি ধান ভাঙানো হয় স্থানীয়পর্যায়ে। সেখান থেকে যথাযথ কুঁড়া সংগ্রহ করা যায় না, গেলেও মানসম্মত হয় না। এছাড়া কুঁড়ার বড় একটি অংশ এখন পোল্ট্রি ফার্ম ও মাছের খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে কাঁচামালের সংকট থেকেই যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল উৎসাহ নিয়ে চালের কুঁড়া থেকে রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু দেড় দশকেও সয়াবিন ও পাম অয়েলের জায়গা দখল করতে পারেনি এ ভোজ্যতেল। স্থানীয় বাজারে জায়গা করতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশি বাজার ধরার চেষ্টা করছে।
সরকার বিশেষ নজর দিলে স্থানীয়ভাবে চাহিদার প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোজ্যতেলের জোগান দেওয়া সম্ভব, বলছেন সংশ্লিষ্টরা / ছবি- সংগৃহীত
এনবিআর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ এর এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ১১ হাজার টন রাইস ব্রান অয়েল রপ্তানি হয়েছে। ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ এর এপ্রিল পর্যন্ত এক লাখ ২৪ হাজার টন রাইস ব্রান অয়েল রপ্তানি হয়েছে। খাত-সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশে যে পরিমাণ কুঁড়া উৎপাদন হয় তার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে উৎপাদন সক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে আমরা অতিরিক্ত পরিমাণ আমদানিনির্ভর। ফলে বিশ্ববাজারের কাছে আমরা জিম্মি বলতে পারেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাজেটে এমন সব পরিকল্পনা থাকা উচিত যাতে দেশীয় উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন। যেমন- উন্নত মানের বীজ সরবরাহ কিংবা বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা। এছাড়া গবেষণায় জোর দেওয়া যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, রাইস ব্রান অয়েলের কাঁচামাল সম্পূর্ণ দেশীয়। তবে দেশীয় হলেও এর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। ফলে বাজারে এর দাম সয়াবিনের তুলনায় বেশ বাড়তি। এ কারণে রাইস ব্রান অয়েল এখনও জনপ্রিয়তা পায়নি। দাম বেশি হওয়ায় অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তা রপ্তানির দিকে ঝুঁকছে। এ তেলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবং উৎপাদন খরচ কমাতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। এ বিষয়ে গবেষণারও প্রয়োজন আছে।
অন্যদিকে, ভোক্তারও কিছু দায়িত্ব আছে। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সরিষার তেলের ব্যবহার মানুষ কমিয়ে দিয়েছে। এক সময় বাদাম তেলের প্রচুর ব্যবহার ছিল কিন্তু এখন মানুষ খায় না। তাই ভোক্তাকেও দেশীয় তেল ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি প্রচারণার পাশাপাশি বাজেটে বাড়তি কিছু উদ্যোগ নিলে রাইস ব্রান অয়েলের জনপ্রিয়তা বাড়বে— মনে করেন ক্যাব সভাপতি।
খবর: ঢাকাপোস্ট