ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বিদ্যুৎ, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), নগদ সহায়তা, খাদ্য, রপ্তানি প্রণোদনা—এসব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ সরকারের বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।
দাম বাড়িয়ে গত কয়েক মাসে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে ভর্তুকি কমিয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ জন্য সরকারকে স্বাগতও জানিয়েছে। তারপরও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারকে বাড়তি ভর্তুকি গুনতে হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ঋণ নেওয়ার আগেই সরকার জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়েছে। তারপরও ভর্তুকি অনেকটা বাড়তে পারে।
আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে গত ৩০ জানুয়ারি। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করার পর সংস্থাটির প্রকাশিত ‘কান্ট্রি রিপোর্টে’ ভর্তুকি আরও কমানোর কথা বলেছে আইএমএফ। ভর্তুকি কমানো মানে দাম বাড়ানো। আর দাম বৃদ্ধি মানেই জনগণের পকেট থেকে বাড়তি টাকা ব্যয়। আইএমএফ অবশ্য মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিন; গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। আইএমএফ বলেছে, এ পদক্ষেপ ভবিষ্যতে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। আইএমএফ অবশ্য স্বীকার করেছে, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পদক্ষেপে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ভর্তুকি কমানোর পক্ষে। ০৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিনিয়োগ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ প্রধানমন্ত্রী ওই দিন আরও বলেন, ‘ইংল্যান্ড ১৫০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এটা সবার মনে রাখতে হবে। আমরা কিন্তু সেই পর্যায়ে যাইনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে ক্রয়মূল্যে। আমরা ভর্তুকি দেব কৃষিতে, খাদ্য উৎপাদনে।’
ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের কারণে দেশের সামাজিক ও উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য আরও অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম এখন বিশ্ববাজারের কাছাকাছি। তবে গ্যাস ও বিদ্যুতে যে ভর্তুকি আছে, তাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় তা শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
ঋণ কর্মসূচি চলাকালে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের উপায় খুঁজে তা বাস্তবায়ন করতে বলেছে আইএমএফ। ঋণ অনুমোদন হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন। জ্বালানির দাম নির্ধারণে নির্বাহী বিভাগকে ক্ষমতা দিয়ে আইনও সংশোধন করেছে সরকার।
ভর্তুকির চাপ আগে থেকেই ছিল
গত ২০২১-২২ অর্থবছর থেকেই ভর্তুকি বৃদ্ধি নিয়ে চাপে ছিল সরকার। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৫৩ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, যা বাড়িয়ে পরে ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা করতে হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ওপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের প্রাথমিক প্রাক্কলনে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৯০ শতাংশ।’
ঋণ দেওয়ার আগে গত অক্টোবর-নভেম্বরে আইএমএফের প্রতিনিধিদল যখন ঢাকায় আসে, তখন পেট্রোবাংলা সংস্থাটিকে জানিয়েছিল, গত জুনে গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানোর পরও প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস বিক্রি করে ৭ থেকে ৮ টাকা লোকসান হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছিল বলেও আইএমএফকে জানায় পেট্রোবাংলা। এ জন্য সরকার ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। আর জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল, গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত মুনাফা এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে।
ঋণ পাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যৌথভাবে আইএমএফকে বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি না যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) আর বাজেট সহায়তা দিতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলে মূল্য সমন্বয়ের জন্য সময়ভিত্তিক উপায় বের করা হবে। ভর্তুকি কমানো হবে বিদ্যুৎ খাতেও।’
বরাদ্দ বাড়বে কি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে
অর্থ বিভাগ এত দিন অবসরভোগী সরকারি কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে রেখে আসছিল। ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে আইএমএফ বলেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তালিকা থেকে এ অংশকে বাদ দিতে হবে। ভর্তুকি কমিয়ে সে অর্থ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ব্যয় করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
সরকার এতে রাজি হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যেই রয়েছে অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন বাবদ ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক বজলুল হক খন্দকার বলেন, ‘আমরা যে কথাটা বলে আসছিলাম, তা এখন আইএমএফ বলল। এখন জানা যাবে, প্রকৃতপক্ষে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কত।’
বজলুল হক খন্দকার বলেন, পেনশন বাবদ অর্থ সামাজিক নিরাপত্তা খাতের তালিকা থেকে বাদ দিলে তা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশের মতো হবে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যদিও তা ৩ শতাংশে রাখার কথা বলা আছে। ভর্তুকি যেহেতু ধনীরাও ভোগ করেন, ফলে তা সরিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এলে গরিবেরা উপকৃত হবেন।