ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: করোনার ধকল কাটিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত এখন পুরোপুরি সক্রিয়। তবে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ার এক বছর পরও এখনও অনেক মানুষ আয়ের দিক থেকে করোনা-পূর্ববতী অবস্থায় ফিরতে পারেননি। সাম্প্রতিক সময়ে এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ। মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। আর করোনার প্রভাব, মূল্যস্ফীতি সবকিছু মিলিয়ে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা এখনও মোট জনগোষ্ঠীর ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ বা ৩ কোটির বেশি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির এ-সংক্রান্ত পঞ্চম রাউন্ডের জরিপে অংশ নেয় প্রায় ৪ হাজার পরিবার।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশ বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে অগ্রাধিকারের প্রধান খাত হওয়া উচিত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম। মানুষের কষ্ট লাঘবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারীরা বাজেটে আরও যেসব খাতে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সুশাসন এবং কৃষি।
পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ‘মূল্যস্ফীতি, মোকাবিলা এবং পুনরুদ্ধারে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক জরিপের ফল প্রকাশ করেন। প্রতিষ্ঠান দুটি এ বিষয়ে প্রথম জরিপটি করেছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনার প্রভাবে ২০২০ সালের জুনে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন দেশের মোট জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ। যদিও গত বছরের মার্চে এ হার পৌনে ১৫ শতাংশে নেমে আসে। এখন ওই হার সাড়ে ১৮ শতাংশেরও বেশি। এর অর্থ, করোনার পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ধীর হওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নতুন করে অনেক মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে যাচ্ছে।
জরিপের তথ্য বলছে, গত বছরের এপ্রিলের দ্বিতীয় দফার লকডাউনের পরে মাথাপিছু দৈনিক আয় বেশ ভালোভাবে আগের অবস্থায় যাওয়ার পথে ছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত আয় বৃদ্ধির হার ছিল ২৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি মূল্যস্ফীতির কারণে জানুয়ারি এবং মের মধ্যে আয় আবার ৬ শতাংশ কমেছে।
হোসেন জিল্লুর বলেন, ২০২০ সালে মহামারি শুরুর আগে শহুরে বস্তিবাসীর মাথাপিছু আয় ছিল ১২৭ টাকা। ওই বছরের মার্চ-মে মাসের লকডাউনে তা ৬৯ টাকায় নামে। গত বছরের মার্চে দ্বিতীয় দফার লকডাউনের আগে এটি ১০১ টাকায় ওঠে। গত জানুয়ারিতে তা ১০৩ টাকায় উন্নীত হয়। কিন্তু এখন ৯৫ টাকা। গ্রামের দরিদ্র মানুষদের আয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম উত্থান-পতন দেখা গেছে। তবে তাদের আয় পুনরুদ্ধার অনেকটা ভালো।
ইমরান মতিন বলেন, কর্মসংস্থান না হওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি মানুষের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি করেছে। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ মানুষই ভোজ্যতেলের ব্যবহার কমিয়েছেন। চাল, মাছ, মাংস, ফল, দুধ কেনাও কমিয়েছেন তাঁরা। মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামাল দিতে পরিবারের অনেক নারী কাজের খোঁজে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাড়তি খরচের লাগাম টানতে অনেকে জামা-কাপড় কেনা ও সন্তানের শিক্ষার ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ টিসিবির পণ্য কেনা বাড়িয়েছেন। এ কারণে টিসিবির পণ্য বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। তবে ৬১ শতাংশ মানুষ জানান, তারা টিবিসির পণ্য কিনতে চাইলেও পারছেন না।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ৩৮ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, প্রয়োজন মেটাতে ঋণ করারও ক্ষমতা হারিয়েছেন। কারণ, তাঁদের অনেকে আগের ঋণই এখনও শোধ করতে পারেননি। অথবা এখন ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নেই।
ইমরান মতিন বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মাঝে মূল্যস্ফীতিজনিত বিপরীত ধাক্কা বড় পরিসরে সংকট বয়ে আনছে। এ সময় সরকারের উচিত সবদিক ভেবে অনানুষ্ঠানিক খাত ও দরিদ্রদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। সামাজিক নিরাপত্তাকে নতুনভাবে সাজানোটাও এখন প্রয়োজন।