ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ২০২২ সালে রাজধানীতে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এ সময় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০.০৩ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত অন্যান্য পণ্যে মূল্যস্ফীতি ১২.৩২ শতাংশ।
অন্যদিকে, দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্টি নিজেদের খাদ্যাভাস এবং জীবন যাত্রার মান কমিয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় পণ্য ও সেবার মূল্য বিষয়ক প্রতিবেদন ২০২২ প্রকাশ শীর্ষক অনলাইন সংবাদ সম্মেলন এ তথ্য জানায় ক্যাব।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন, স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, ক্যাবের যুগ্ম সম্পাদক ডা. মো. কাহনেওয়াজ চৌধুরী, ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ ডা. মো. মুঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার ও ভোক্তাকণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান।
ক্যাবের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষনা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর।
প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকায় ১১টি খুচরা বাজার এবং বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবার তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালের প্রথম মাসের তুলনায় ১১.০৮ শতাংশ বেশি ছিল। যদিও গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি আর খাদ্যবহির্ভূত অংশের তুলনায় কম ছিল যথাক্রমে ১০.০৩ ও ১২.৩২ শতাংশ, উভয়ই দুই অঙ্ক স্পর্শ করেছে। তবে সাধারণ পরিবারের তুলনায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর গড় মূল্যস্ফীতির চাপ ৯.১৩ শতাংশ কম ছিল। বার্ষিক খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি যথাক্রমে ১০.৪১ ও ৭.৭৬ শতাংশ কম ছিল, যদিও উভয় শ্রেণির পণ্য ও সেবা মৌলিক প্রকৃতির ছিল।
ক্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৬.৫০ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ শতাংশ।
বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি গত আগস্টে সর্বোচ্চ ৯.৫২ শতাংশ উঠেছিল। এর পর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই হার কমে ৮.৮৫ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু আলোচ্য এ সময়ে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বেশ কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। তাতে দেখা যায়, চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এবং চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু মিল মালিক। এছাড়া চালের বাজার কর্পোরেট কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ফলপ্রসূ হবে না।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালের পর গত বছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। শহর ও গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা বাংলাদেশের লাখ লাখ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের দুর্দশা বাড়িয়েছে।
ক্যাব বলেছে, গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমত, ঢাকা মেগাসিটির ব্যক্তি পর্যায়ের ভোক্তারা খাদ্যবহির্ভূত ঝুড়িতে আপেক্ষিকভাবে খানিকটা বেশি ব্যয় করেন, যার মধ্যে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং বিভিন্ন পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে উচ্চ খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টিকারী এই জিনিসগুলোর এক ধরনের টেকসই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী খুব মৌলিক, কম দামের এবং সীমিত খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করে, যার মধ্যে কিছু দামের ক্ষেত্রে মৌসুমি প্রভাব (যেমন- ফল ও সবজি) এবং তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল মূল্যের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। কারণ এগুলোর সরবরাহ শক্তিশালী (যেমন- মোটা চাল ও সস্তা মাছ)।
সুপারিশে ক্যাব বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কাভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম শক্তিশালী করা উচিত। দেশে এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক পণ্য এবং দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ টাকা হস্তান্তর কর্মসূচি বাড়ানো উচিত। যেহেতু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় শহুরে জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপ এবং অসহায়ত্বের সম্মুখীন হয়, তাই সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া শহুরে নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
সুপারিশে ক্যাব আরও বলছে, মৌলিক জ্বালানি পণ্য, বিশেষ করে ডিজেলের ওপর আবার ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে, কারণ এটি সেচ এবং জনসাধারণ ও পণ্য পরিবহন খরচের একটি বড় অংশ নির্ধারণ করে। এ ছাড়া বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো উচিত। সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ক্যাব ও গণমাধ্যমকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গত এক দশকে দেশের উন্নয়ন বেড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। তবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু তা সত্তেও দেখা যাচ্ছে এখনও প্রায় ৪ কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছেন। তাই মুদ্রাস্ফীতিটা মানুষের জীবনে একটা কাল হয়ে আসে।
তিনি বলেন, ২০২২ সাল খুব স্বস্তির ছিল না। এ পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বেই একই পরিস্থিতি ছিল। করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত তাই তার প্রভাব বাংলাদেশেও পরেছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে করোনার সময় এবং করোনা পরবর্তী সময়ে অনেক মানুষের আয় কমেছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদিও হিসেবে দেখা যায়, আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। তবে সেই বৃদ্ধিটা উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে অধিক হয়েছে বলে ধারণা। এতে করে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন মানে একটা নীতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, সরকার অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারের পদক্ষেপের কারণে যে নেতিবাচক প্রভাব যত তীব্র হতে পারতো তা হয়নি। অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে আছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত মানুষের ক্ষেত্রে।
ক্যাব সভাপতি বলেন, দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে যে তা কমে আসবে এমন আসা করাটা ঠিক নয়। আমরা শায়েস্তখানের আমলে ফিরে যেতে পারবো না। তাই মানুষের আয় যাতে বাড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের উপর গুরুত্বরোপ করতে হবে। এবং মানুষের আয় যেন মূদ্রাস্ফীতির থেকে বেশি হয়, যাতে মানুষের জীবন মানের উন্নতি হয়, পুষ্টির পরিবেশ যাতে আরও উন্নত হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে। তাই সরকারকে বৈষম্য কমাতে বিত্তবানদের আয়ের থেকে সাধারণ মানুষের আয় এবং নিন্মমধ্যবিত্তদের আয় বৃদ্ধিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে সংকট আরও বাড়বে।