সাত বছরের বেশি সময় ধরে রাজধানীর বৃত্তাকার নৌপথে ১২টি ওয়াটার বাস চলাচল করছে না। এর মধ্যে ছয়টি অকেজো, চারটি বুড়িগঙ্গায় অন্যদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর বাকি দুটি চট্টগ্রামে সমুদ্র উপকূলে পাঠানো হয়েছে। যার একটি যাত্রী পরিবহণ করলেও অন্যটি অলস পড়ে আছে। দৈনিক যুগান্তর থেকে জানা যায়, ৯ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, ঢাকা শহরের যানজটের চাপ কমিয়ে চারপাশের নদ-নদীগুলোয় প্রাণ ফেরানোর লক্ষ্যে এ প্রকল্পটি নেওয়া হলেও সেটি কার্যকর ছিল মাত্র একটি বছর। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার জন্যই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে ছিল না কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনা। ফলে এটি এখন সরকারের মন্দ বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর দখলমুক্ত করে নাব্য বৃদ্ধি করে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর। সে লক্ষ্যে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনাও আলোচনা করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সার্বিকতা নির্ভর পরিকল্পনা না করে তড়িঘড়ি করে ওয়াটার বাস ক্রয় করে। এটা ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনার মতো ঘটনা ঘটেছে, সে কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।’
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর চারপাশের বৃত্তাকার নৌপথে চলাচলের জন্য ওয়াটারবাস ক্রয়ের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ছিল। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি সেটাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেনি। সে কারণে এ উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ওয়াটার বাসের ক্ষেত্রে চিন্তা করা দরকার ছিল বাসের চেয়ে ভাড়া কম নির্ধারণ করা। একই সঙ্গে ওয়াটার বাসের চলাচল আরামদায়ক করা। বিআইডব্লিউটিসি এটাকে কার্যকরভাবে সমন্বয় করতে না পারার কারণে এ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। আমাদের চারপাশের নদীতে সারা বছরই নাব্য থাকে, তবে শুষ্ক মৌসুমে পানি দুর্গন্ধ থাকে। বর্ষা মৌসুমে তো এটা অনেক জনপ্রিয় করে তোলা যায়।’
এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিসির যাত্রীসেবা ইউনিটের উপ-ব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, ‘ভালো চিন্তা থেকে সরকার ওয়াটারবাস চালু করেছিল। কিন্তু নদীর পানি দূষণ, ল্যান্ডিং স্টেশন, ওয়ার্কওয়ে, বনায়ন, নদীর পাড়ের সৌন্দর্য বর্ধন ও নৌঘাট থেকে শহরে চলাচলের যানবাহনের ব্যবস্থা না করায় এ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘নদীর নাব্য কম থাকায় চলাচলেও সমস্যা সৃষ্টি হতো। নৌপথের পরিবেশও ভালো ছিল না। জোরে ওয়াটারবাস চললে নদীরপাড় ভেঙে যেত, এ কারণে নদীর পাড়ের বাসিন্দারা ওয়াটারবাসে ইট, পাথর ছুড়ে মারত। এছাড়া নদীতে চলাচলকারী অন্যান্য যানবাহনও ডুবে যেত। এমন নানামুখী সমস্যার কারণে ওয়াটারবাস সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে। এখন সেগুলো বিকল্প ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার নৌপথ সচল করতে বর্তমানে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নিচু সেতু ভেঙে নৌচলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে। এছাড়া নদীর পাড় বাঁধাই, ওয়ার্কওয়ে নির্মাণসহ বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ উদ্যোগুলো আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। এগুলো ধাপে ধাপে কার্যকর হলে বিআইডব্লিউটিসি আরও আধুনিক মানের ওয়াটারবাস চালু করবে।’
জানা যায়, ওয়াটার বাস চালুর আগে বৃত্তাকার নৌপথে নতুন করে ১০টি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ করার কথা ছিল। একই সঙ্গে এসব ল্যান্ডিং স্টেশনের সঙ্গে শহরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যানবাহনের আয়োজন করে ওয়াটার বাস চালু করার দরকার ছিল। এসব আলোচনা এবং দায়িত্বও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব কাজ বাস্তবায়নের আগেই ওয়াটার বাস ক্রয় করে চলাচলের চেষ্টা করা হয়। এর অংশ বিশেষ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। এছাড়া নদ-নদীগুলোর পানির দূষণ প্রতিরোধ, পাড় বাঁধাই ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টি করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টার্গেট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। এদিকে নদ-নদীতে চলাচলের উপযোগিতা বিবেচনা না করেই তড়িঘড়ি করে ওয়াটার বাস ক্রয় করে ফেলে বিআইডব্লিউটিসি। যে কারণে ওয়াটার বাস চালুর বছরখানেকের মধ্যে সেসব গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। সেসব যানবাহন বিআইডব্লিউটিসি’র গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্র জানায়, ওয়াটার বাসের ৬টিই অকেজো হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৪টি নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে ফেলে রাখা হয়েছে। বাকি দুটি পড়ে আছে বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাটে। আর ৪টি ওয়াটার বাস নৌকা মাঝি সমিতিকে নামমাত্র ভাড়ায় চাটারে দেওয়া হয়েছে। তারা ওয়াইজ ঘাট থেকে কেরানীগঞ্জে যাত্রী পরিবহন করছে। বাকি দুটি চট্টগ্রামের উপকূলে পড়ে রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, ওয়াটার বাসগুলো নদীতে চালানোর সময় পানি থেকে উৎকট গন্ধ মিলত। এছাড়া নদীর নাব্য সংকট, দ্রুতগতিতে ওয়াটার বাস চালাতে নদী পাড় ভেঙে যাওয়া এবং নদীর ছোট নৌকা ডুবে যাওয়াসহ প্রভৃতি কারণে ওয়াটারবাস চালানো দুরূহ হয়ে ওঠে। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তক্রমে রাজধানীর বৃত্তাকার পথে ওয়াটার বাস চালানো বন্ধ করা হয়। দীর্ঘদিন এসব ওয়াটার বাস বন্ধ ফেলে রাখার কারণে বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু ওয়াটার বাস এতদিন সচল থাকলেও সেগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে।