মহামারি করোনার মধ্যেও গত অর্থবছরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক প্রবাসী আয় উল্লম্ফন ছিল। কিন্তু তাতে ভাটা পড়েছে। টানা চার মাস ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় কমেছে। গত অক্টোবর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ।
সোমবার (১ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা ধরে) যার পরিমাণ ১৪ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার বা ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ কম। ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ২১০ কোটি ২১ লাখ ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অবৈধ চ্যানেলগুলোতে অর্থাৎ হুন্ডিতে অর্থ লেনদেন বেড়েছে। এছাড়া মহামারিতে যে হারে প্রবাসীরা চাকরি হারিয়েছেন সেভাবে নতুন বৈদেশিক নিয়োগ হয়নি। এসব কারণে প্রবাসীদের আয় কমছে।
এদিকে রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রফতানিও কম। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে। যে কারণে ডলারের দর বেড়ে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেই রোববার ৮৫ টাকা ৭০ পয়সায় উঠেছে। খোলা বাজারে খুচরা ডলারের দাম উঠেছে ৯০ টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত চার মাস ধরে ধারাবাহিক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ১৭২ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। তার আগের মাস আগস্টে এসেছিল ১৮১ কোটি ডলার। যা তার আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে ৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার কম। এছাড়া আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ কোটি ৩৮ লাখ বা প্রায় ৮ শতাংশ কম। এর আগে চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশে ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। যা তার আগের মাস জুনের চেয়ে ৬ কোটি ৯৩ লাখ ডলার কম। এছাড়া আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ কম।
মহামারিতে আয় কমলেও দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছিল, যার বড় একটি অংশ আগে মূলত অবৈধ পথে আসত। করোনায় বিশ্বজুড়ে লকডাউনে আকাশ পথে যোগাযোগ ও অবৈধ পথ বন্ধ থাকার ফলে সব আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে। এখন যোগাযোগ শুরু হওয়ায় বৈধপথে রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে। আগামী দিনে যা আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, বলছেন ব্যাংকাররা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৩২ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের মধ্যে একটিতে এসেছে ৩ কোটি ৫২ লাখ ডলার। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১২৭ কোটি ৫২ লাখ ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৭৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
বরাবরের মতো বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অক্টোবরে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৪১ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার। এছাড়া ডাচ বাংলা ব্যাংকে এসেছে ১৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩ কোটি ১৮ লাখ ডলার, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ কোটি ৮৭ লাখ ডলার এবং ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে
রেমিট্যান্স এসেছে ৮ কোটি ২৬ ডলার।
সবশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর শেষে বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন বা চার হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার। তবে গত ২৪ আগস্ট এ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ছাড়িয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের এসডিআর বরাদ্দ (ঋণ-সহায়তা) যোগ হওয়ায় বেড়েছিল। এরপর রেমিট্যান্স রফতানি তেমন ইতিবাচক না হওয়ায় রিজার্ভ কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি বাংলাদেশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অর্থবছর হিসাবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। তারও আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণের রেকর্ড হয়। ওই সময় এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা যোগ করে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন সুবিধাভোগী।