ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলার সংকটে দেশ। রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে এখন ৩৬ বিলিয়নে নেমেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স ভরসার জায়গা হলেও গত মাসে (অক্টোবর) এই দুই খাতেই ডলার অনেক কম এসেছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বায়াররা আগের অর্ডারের পণ্য তো নিচ্ছেন না বরং বিক্রি করার অর্থও দিচ্ছেন না। এজন্য রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে কিছুটা কমেছে রপ্তানি। তবে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য সার্বিকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধ হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
অপরদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত চার মাসে রেমিট্যান্স কম এলেও আগের অর্থবছরের চেয়ে এটা বেশি। তবে রেমিট্যান্স যাতে বেশি করে দেশে আসে সে জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশে আমদানি ব্যয় কমেনি। বরং প্রতি মাসে বাড়ছে। এরফলে দেশে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। সরকার বিলাসী পণ্যের আমদানি টেনে ধরতে শুল্ক বৃদ্ধি ও ঋণ মার্জিন ১০০ ভাগ করাসহ বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে। তবে বেসরকারিখাতের আমদানি কমলেও জ্বালানি ও সারের জন্য রিজার্ভ থেকেই এলসি খুলতে হচ্ছে। এতে রিজার্ভের উপর চাপ পড়েছে। গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকলেও কমতে কমতে ৩৬ বিলিয়নে নেমে গেছে।
এদিকে রেমিট্যান্স কমার ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, গত মাসে রেমিট্যান্স কমেছে, এটা সত্য। তবে গত চার মাসে দেশে প্রবাসীরা যে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। কারণ গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৭১৯ কোটি ৮১ লাখ ডলার। আর গত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৭০৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার। গত চার মাসে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে ১৪ কোটি ২৯ লাখ ডলার বা ২ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ।
এই মুখপাত্র বলেন, ডলার সংকটের কারণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য আমদানি ব্যয় কমেছে। তবে সরকারের কিছু পণ্য আমদানি তো করতেই হবে। এজন্য রিজার্ভ থেকেই সাপোর্ট দিতে হচ্ছে। এতে রিজার্ভ কিছুটা কমছে। তবে ব্যাংকগুলোর আমদানি ব্যয় মেটাতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা সেভাবে কাজ করছে, যাতে ডলার বেশি আসে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সব কিছু স্থবির হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের বায়াররা নতুন করে কোনো অর্ডারতো নিচ্ছে না বরং আগের অর্ডার করা মালও নিচ্ছে না ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। শুধু তাই নয়, তিন থেকে চার মাসের বিলও দিচ্ছে না। এ জন্য অক্টোবরে রপ্তানি আয় কম এসেছে।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বিভিন্ন চেষ্টা করছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। কিন্তু গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। বরং ঋণাত্মক হয়েছে সোয়া তিন শতাংশ। তবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশ। লক্ষ্য থেকে পিছিয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। একই সঙ্গে গত মাসে প্রবৃদ্ধিও কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
রপ্তানি আয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে গত মাসে (অক্টোবর) রপ্তানি আয় একটু কমেছে। কারণ ইউরোপে রপ্তানি কমেছে। তবে গত অর্থবছরের চেয়ে এটা বেশি। এ সময়ে সাধারণত একটু কম যায়। আশা করি আগামী মাসে বৃদ্ধি পাবে। কারণ আমরা প্রতিনিয়ত পণ্যের ও বাজারের ডাইভারসিফিকেশনের (বহুমুখী) চেষ্টা করছি।
ইপিবি গত বুধবার (২ নভেম্বর) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত অক্টোবরে ৫০০ কোটি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। কারণ গত বছরের অক্টোবরে রপ্তানি হয়েছিল ৪৭২ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পণ্য। অপরদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭৪২ কোটি। তাতে এক হাজার ৬৮৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কমেছে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে এটা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। কারণ ওই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল এক হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার।
ইপিবি সূত্র জানায়, রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি হয় তৈরি পোশাক থেকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তৈরি পোশাকের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়লেও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, কেমিক্যাল পণ্য, হ্যান্ডিক্রাফটস, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্যসহ প্রায় পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে এই চার মাসে।
রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী আয় সেপ্টেম্বরের মতোই কেটেছে অক্টোবর মাস। প্রবাসীরা গত মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার। যা গত আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ (১.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ (১.৬৪ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। বছরের ব্যবধানে ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছে।
এভাবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ কমে যাওয়া ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে রিজার্ভও কমছে। তা ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলারও বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছরের (২০২১) আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটির (৪৮ বিলিয়ন) ডলারের বেশি। পরের মাসে কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারে। আমদানি বৃদ্ধির কারণে এভাবে প্রতি মাসে রিজার্ভ কমছে।
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ কমতে কমতে গত মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দিন শেষে ৩৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তাই রিজার্ভ নেমে আসবে ৩৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাবের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাটি বলছে রিজার্ভের এটা প্রকৃত হিসাব নয়। অপরদিকে, বিশ্বমন্দার প্রভাবে বাংলাদেশও ডলার সংকটে পড়েছে। এই সংকট মোকবিলায় সরকার আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চেয়েছে। তা নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকায়। ইতোমধ্যে গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
রপ্তাকিারকদের ঋণ সহায়তা দিতে ইডিএফসহ তিনটি তহবিল গঠন করা হয়েছে রিজার্ভ থেকে। যা চাহিবা মাত্র পাওয়া যায় না। এটা বাদ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তাই বিভিন্ন তহবিল বাদ দিলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে।