ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সরকারি খাতে আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে খরচ বেড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় বাড়তি খরচ মেটাতে চাহিদা অনুযায়ী আয় বাড়াতে পারছে না সরকার। ফলে সরকারের দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। অন্যান্য সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নিত। এখন তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমে গেছে।
ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ০৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে নতুন কোন ঋণ নেয়নি। বরং আগের ঋণ থেকে ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের কারণে বেসরকারি খাতের মতো সরকারি খাতেও আমদানি ব্যয় লাগামহীন ভাবে বেড়েছে। এর প্রভাবে দেশের ভেতরেও প্রায় সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে।
এতে সরকারকে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নানা ধরনের খাদ্য সহায়তা দিতে হচ্ছে। এ কারণে আমদানিও বাড়াতে হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার, ওষুধসহ অন্যান্য সামগ্রীও আমদানি বাড়াতে হয়েছে। এতে সরকারের খরচ বেড়েছে।
এদিকে, মন্দার কারণে সরকারের আয় বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সরকারের আয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আয় বৃদ্ধির হার কমেছে ৩ শতাংশ।
জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১৫ শতাংশ, গ্যাস আমদানি ব্যয় ৭৭ শতাংশ, সার ১০৮ শতাংশ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় ১৭ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া অন্যান্য বড় প্রকল্পের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। চাহিদা মেটাতে সরকারকে চিনি, ভোজ্যতেল, চাল, গম আমদানি করতে হচ্ছে। এসব খাতেও বাড়তি খরচ হচ্ছে।
এছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়ও বাড়তি খরচ করছে। ব্যয় বাড়ার তুলনায় রাজস্ব আয় না বাড়ায় এসব অর্থের জোগান দিতে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ০৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার নতুন কোন ঋণ নেয়নি। বরং আগের নেওয়া ঋণের মধ্যে ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল।
গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ওই ঋণের একটি অংশ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করেছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চলছে। বর্তমানে তা আরও প্রকট হয়েছে।
ব্যাংকে আমানত প্রবাহ হ্রাস, ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে মন্দা, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেওয়া ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় নতুন সঞ্চয় কমার কারণে ব্যাংকে নগদ অর্থে টান পড়েছে। যে কারণে সরকার এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নিচ্ছে না।
এক্ষেত্রে সরকার রাজস্ব আয় অর্থের ঋণ পরিশোধ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে তারল্যের জোগান বাড়াচ্ছে।
গত ০১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের মধ্যে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল। কিন্তু অগাস্ট থেকে সরকারের ঋণ বাড়তে থাকে। গত ০৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার মোট ঋণ নিয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ৫০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাকি ১৯ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ঋণ নিয়েছিল নয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমেছে ৬৩৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থ বলা হয়। এ অর্থ বাজারে গিয়ে টাকার প্রবাহ দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে দেয়। ফলে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ এ ধরনের মুদ্রানীতির পরিপন্থি। কেননা সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির মূল্য লক্ষ্য হচ্ছে, টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির হার কমানো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে টাকার প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির হারও বাড়ে।