ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: আমদানিতে নানা শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কমছে আমদানি। অন্যদিকে প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। যার কারণে হু হু করে বাড়তে থাকা মার্কিন ডলার এখন উল্টো পথে হাঁটছে। কমছে ডলারের দাম। বাড়ছে টাকার মান।
গত সপ্তাহে কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ ডলার যেখানে ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল; চলতি সপ্তাহের বুধবার ও বৃহস্পতিবার কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ ডলার নেমে এসেছে ১১০ থেকে ১১১ টাকায়। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলাবাজারে ডলারের দাম কমেছে ১০ টাকা।
এদিকে দেশে ডলারের সংকট কাটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানিতে দেওয়া হয়েছে নানা শর্ত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দেওয়া হয়েছে নীতিগত ছাড়। এছাড় ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ডলার কারসাজিকারীদের ধরতে চালাচ্ছে অভিযান। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখাপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মানি চেঞ্জারদেরকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় রেট থেকে এক টাকা বেশি দামে ডলার ক্রয় করে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফা করতে বলা হয়েছে। এর আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ মুনাফার সীমা এক টাকা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর মহাসচিব মো. হেলাল সিকদার বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা মুনাফার হার সর্বোচ্চ দেড় টাকা পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে।’ এছাড়াও ডলারের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে বলে তিনি জানান।
চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১৬ দিনে ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ১১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।
কমেছে আমদানি এলসি কমার হারও। আমদানির লাগাম টানতে যেসব শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তার সুফল আসতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা জুলাই মাসের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। জুলাই মাসে আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল জুলাই মাসে দেশে মোট ৫৫৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা জুন মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। তবে জুন মাসে অবশ্য মে মাসের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র ৭ শতাংশ বেশি খোলা হয়েছিল। মে মাসে ঋণপত্র খোলা হয় ৭৪৪ কোটি ডলারের।
এপ্রিল মাস থেকে আমদানি কমতে শুরু করে। এপ্রিল মাসে মার্চের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। মে মাসেও এপ্রিলের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। ফলে বিগত কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।
১৬ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৯৫৪ কোটি (৩৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন) ডলারে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে মজুত এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে প্রায় ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে রাশ টানার উদ্যোগ শুরু হয় গত মে মাস থেকে। তবে ৪ জুলাই এক্ষেত্রে বেশ কঠোরতা আরোপ করা হয়। গাড়ি, সোনা, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে শতভাগ। আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহারি কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সবক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার হবে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে মার্জিনের জন্য ঋণ দেওয়া যাবে না। এর মানে এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে পুরো অর্থ নগদে দিতে হবে।
এর আগে গত ১০ মে-র নির্দেশনায় কিছুর্জিনে পণ্যে এলসি মার ন্যূনতম হার ৫০ ও ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাংকের রপ্তানি আয় অন্য ব্যাংকে ভাঙানোর ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেওয়া ঋণ কেবল রপ্তানি আয় বা জমা থাকা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেওয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় গত ৮ আগস্ট দেশি-বিদেশি ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
এছাড়া ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। কারসাজির অপরাধে মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করাসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে।
এদিকে মানি চেঞ্জাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে লাইসেন্স প্রাপ্ত ২৩৫টি মানিচেঞ্জার ছাড়া অন্য সব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া মানি চেঞ্জারদের দিনশেষে ডলার রাখার সীমা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজারে উন্নীত করা, সমিতির সদস্যদের পাসপোর্টে বার্ষিক এনডোর্স সীমা ১ হাজার ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ৫ হাজার ডলার করা, একটি পাসপোর্টে বছরে ১ হাজার ডলার এনডোর্স ও বিদেশগামীদের সঙ্গে করে ১২ হাজার ডলার বহনের অনুমোদন পুনর্বিবেচনা এবং পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স সীমা ও ব্যাংক-কার্ডের লেনদেন সীমা সমন্বয় করা। অন্যদিকে মানি চেঞ্জিংয়ের ব্যবসা সনদ নবায়নে বার্ষিক ৫ হাজার ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের শর্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়।