গত বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ জারি করা হলে মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। ওই সময় জরুরি আর্থিক সেবা দিতে ব্যাংকগুলো তাদের কিছু শাখা খোলা রাখে। তখন ব্যাংকগুলোর ভোক্তাঋণ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
তবে বছরের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতিকে ‘নতুন স্বাভাবিক’ হিসেবে বিবেচনা করে ব্যাংকগুলো আবারও ভোক্তাঋণ বিতরণে মনোযোগ দেয়। এর ফলে তাদের এ ব্যবসা আবারও আগের ধারায় ফিরতে শুরু করে, যা এখন আরও জোরদার হয়েছে। এটাকে মানুষের মধ্যে করোনার ক্ষত কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে।
করোনা আসার পর করপোরেট ঋণের চাহিদা কমে যায়। টাকা তো আর ফেলে রাখা যায় না। এ জন্য সবাই ভোক্তাঋণে মনোযোগ বাড়িয়েছে।
মোটাদাগে ভোক্তাঋণের মধ্যে রয়েছে ফ্ল্যাট ও গাড়ি ক্রয়, বাড়ি নির্মাণ, ব্যক্তিগত ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ঋণ। ব্যক্তিগত ঋণকে বেশির ভাগই জরুরি খরচ, আসবাব, ইলেকট্রনিক কেনাকাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন। এসব ঋণের সুদহার এখন সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। কিছু ব্যাংক অবশ্য আরও কম সুদে ভোক্তাঋণ দিচ্ছে।
সব ব্যাংকেরই ভোক্তাঋণ সেবা রয়েছে। তবে এ ঋণে জোর দেওয়া দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্-বাংলা, প্রাইম, ইস্টার্ণ, ইউসিবিএল ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক বেশি এগিয়ে আছে।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘মানুষ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সর্বদাই আগ্রহী। এখন আমাদের মাথাপিছু আয়ও ঊর্ধ্বমুখী। আর দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেশ বাড়ছে। এ কারণে ভোক্তাঋণের চাহিদাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।’
মাসরুর আরেফিন আরও বলেন, ‘মানুষের চলমান ঋণের চাহিদা মেটানোর প্রয়াসে সিটি ব্যাংক এ বছরের প্রথম ৯ মাসেই ভোক্তাঋণ বিতরণ করেছে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এ অর্থ প্রায় ২৭ হাজার ভোক্তার ঋণের চাহিদা পূরণ করেছে। আশা করছি, বছর শেষে আমাদের ভোক্তাঋণের পরিমাণ ২ হাজার ১০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে। তখন ভোক্তার সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৫ হাজার। এতে আমাদের ভোক্তাঋণের পোর্টফোলিও গত বছরের তুলনায় পরিমাণে ২০ শতাংশ ও সংখ্যায় ৩০ শতাংশের মতো বাড়বে।’
ভোক্তাঋণ বিতরণে শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, করোনার শুরুতে ঋণ বিতরণ বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যক্তিগত ঋণের চাহিদা ছিল। কিন্তু ঋণ দিতে গেলে গ্রাহকের বাড়ি বা অফিস পরিদর্শনসহ নানা খোঁজখবর নিতে হয়, যা তখন সম্ভব ছিল না। এ কারণে লোকবলও কমিয়ে ফেলা হয়। তাই চাহিদামতো ঋণ দেওয়া যায়নি। এখন অবশ্য বড় ঋণের চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো এ খাতে আগ্রহ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের একটা সময় করোনাজনিত বিধিনিষেধের কারণে ব্যাংকগুলোর ভোক্তাঋণ ব্যবসা যেমন বন্ধ ছিল, তেমনি গ্রাহকেরাও ব্যাংকে যাওয়া কমিয়ে দেন। তবে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভোক্তাঋণে বড় উল্লম্ফন হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভোক্তাঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে হয় ৬৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ ঋণ কমে হয় ৬৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে ৮৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত ভোক্তাঋণে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এরপর তা আরও বেড়েছে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘করোনা আসার পর করপোরেট ঋণের চাহিদা কমে যায়। টাকা তো আর ফেলে রাখা যায় না। এ জন্য সবাই ভোক্তাঋণে মনোযোগ বাড়িয়েছে। আমাদের ভোক্তাঋণের ৪০ শতাংশই যাচ্ছে ফ্ল্যাটে। ভোক্তাঋণে আমরা সুদ কম নিচ্ছি। শুধু রেডি ফ্ল্যাট কিনতে এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি গাড়ি কিনতে ও ব্যক্তিগত ঋণও আমরা দিচ্ছি।’
আলাপকালে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভোক্তাঋণে গ্রাহকদের যেমন চাহিদা রয়েছে, ব্যাংকগুলোও এখন তা বাড়ানোর পক্ষে। কারণ, বড় ঋণ এখন নেই। আবার আমানতের সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। তবে সমস্যা হলো পুরোনো ঋণ আদায় হচ্ছে না। কারণ, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে আবাসন খাতে ঋণ ছিল ১৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যা গত ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যক্তিগত ঋণ ছিল ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা গত বছরে বেড়ে ৩৫ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা হয়। একই সময়ে ক্রেডিট কার্ডের ঋণও ৫ হাজার ৪৯০ কোটি থেকে বেড়ে হয় ৫ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। তবে গাড়ি কেনার ঋণের স্থিতি তখন কমে যায়। ২০১৯ সালে গাড়িঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে কমে হয় ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গাড়িঋণ বাড়ছে। কারণ, করোনা থেকে সুরক্ষায় অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনছেন। আবার সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি কেনার ঋণসুবিধাও বাড়ানো হয়েছে।
দুটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের মধ্যে ভোক্তাঋণ দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা। এ জন্য নতুন লোকবলও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, সুদহার ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় গ্রাহকেরা এখন জেনেবুঝেই ভোক্তাঋণে ঝুঁকছেন। এতে ব্যাংকগুলোও ভালো সুদ পাচ্ছে। আর ভোক্তাঋণ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় ব্যাংকগুলো এর বিতরণ বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতি যে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তারও একটা ইঙ্গিত মিলছে ভোক্তাঋণ বৃদ্ধির মাধ্যমে।