ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: গত এক বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে ৯৫৮৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে বেড়েছে দেড় হাজার কোটি ডলার। এর আগের এক বছরে বেড়েছিল ১২৯৮ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২ কোটি ডলার।
ঋণের বিপরীতে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়লেও মূলধন বেড়েছে খুবই কম। উলটো অর্থনৈতিক মন্দা ও তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ বেড়েছে।
সোমবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতি ছয় মাস পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনটি প্রকশ করে। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৮৬ কোটি ডলার। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এ ঋণ ছিল ৮ হাজার ১৫৭ কোটি ডলার। আলোচ্য এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪২৯ কোটি ডলার। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ ছিল ৬ হাজার ৮৫৯ কোটি ডলার। ২০২০ সালের জুনের তুলনায় ২০২১ সালের জুনে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছিল ১ হাজার ২৯৮ কোটি ডলার।
বৈদেশিক ঋণের মধ্যে আগের তুলনায় গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। দ্রুত কম সময়ে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হয়, সুদের হারও বেশি। ফলে অর্থনীতিতে ঝুঁকির সৃষ্টি করে। তবে জিডিপির হিসাবে ঋণের অনুপাত এখনও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।
গত জুন পর্যন্ত মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতে ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার এবং সরকারি খাতে ৬ হাজার ৯৯১ কোটি ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ৭ হাজার ৫২১ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৬ হাজার ৭০২ কোটি ডলার ও বেসরকারি খাতে ৮ হাজার ১৯৫ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ২ হাজার ৬৫ কোটি ডলার ঋণে সরকারি খাতে ২৮৯ কোটি ডলার, বেসরকারি খাতে ১ হাজার ৭৭৬ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ সরকারি খাতে খুবই কম, কিন্তু বেসরকারি খাতে বেশি। এ কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। সরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেশি, বেসরকারি খাতে কম।
দেশের মোট জিডিপির হিসাবে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ১ শতাংশ। গত বছরের জুনে জিডিপিতে বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ছিল ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।
গত বছরের জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ১ হাজার ৪০৪ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঋণ বেড়েছে ৬৬১ কোটি ডলার। একই সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৭৫৩ কোটি ডলার। এ খাতে ঋণ বেড়েছে ৭৬৮ কোটি ডলার। তবে শতকরা হিসাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বেড়েছে। যেগুলো আগামী এক বছরের মধ্যেই পরিশোধ করতে হবে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়াগ বা এফডিআই এসেছিল ২৫১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ৩৪৪ কোটি ডলার। এক বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ। তবে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের স্থিতি বেড়েছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থিতি ছিল ১ হাজার ৯৯৫ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫০ কোটি ডলার। নিট হিসাব জিডিপির মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগের অবদান ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল দশমিক ৭১ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। এক বছরে এ খাতে এফডিআইয়ের অবদান বেড়েছে মাত্র দশমিক ০৩ শতাংশ।
গত অর্থবছরের বিনিয়োগের মধ্যে নিট পুঁজি হিসাবে বিদেশ থেকে এসেছে ৫১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ। দেশে অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ হয়েছে ১২২ কোটি ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানি ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে ৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ নিট বিনিয়োগের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ। বিদেশি বিনিয়োগের বড় অংশই দেশে অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ করা।
গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬২ কোটি ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে চীন ২৭ কোটি ডলার। তৃতীয় অবস্থানে সিঙ্গাপুর ১৬ কোটি ডলার।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ৬৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ডলার। এক বছরে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ৭ কোটি ডলার।
এদিকে বাংলাদেশ বিদেশি পুঁজি আকর্ষণের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিলেও বিনিয়োগকারীরা দেশ থেকে বৈধভাবে পুঁজি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করছেন। গত এক বছর ধরে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চললেও দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নিয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। গত অর্থবছরে দেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছিল ৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার। এক বছরে দেশের বাইরে বিনিয়োগ নেওয়া বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে বিদেশে নেওয়ার মধ্যে ৭০ লাখ ডলার নগদ পুঁজি হিসাবে, বিদেশে অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ডলার। বিদেশে বাংলাদেশের বিনিয়োগের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ডলার। আগের বছরে তা ছিল ৩৭ কোটি ডলার। এক বছরে বেড়েছে ৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের এ হিসাব শুধু বৈধভাবে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরে বেআইনিভাবে আরও অনেক বেশি পুঁজি বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার তথ্য এ প্রতিবেদনে নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, দেশে গত মে থেকে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এর আগে সংকট ছিল না। বরং উদ্বৃত্ত ছিল। যে কারণে গত মে মাসের আগেই দেশ থেকে ওইসব পুঁজি বিদেশে নেওয়া হয়েছে। সংকট শুরুর পর দেশ থেকে কোনো পুঁজি বিদেশে নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়নি।