ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ভারতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে সুবাতাস বইছে। ইতোমধ্যে দেশটি থেকে রেকর্ড পরিমাণ এসেছে রপ্তানি আয়। শুধু তাই নয়, দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতিও কমে আসছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশি পণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ায় চাহিদা বাড়ছে ভারতে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের ঘরে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫৫.৬২ শতাংশ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশটিতে রপ্তানি বেড়েছে ২০.৫৩ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে ভারতের নাম। সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন ও পোল্যান্ড। পোল্যান্ড ও ভারতে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি। গত অর্থবছরে পোল্যান্ডে রপ্তানি হয়েছে ২১৪ কোটি ২৪ লাখ ডলারের পণ্য।
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। এখন ভারতে রপ্তানি বাণিজ্য আরও বাড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও মনে করছেন, ভারতে রপ্তানি বাড়বে। সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মনে করেন, চলতি অর্থবছরে ভারতে অন্তত তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হবে।
আমদানি-রপ্তানিকারকরা বলছেন, এতদিন ভারত থেকে আমদানি হতো- এমন অনেক পণ্যই এখন রপ্তানি তালিকায় যুক্ত হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে- পাটজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, অ্যাসিড, কাগজ, লোহা, টিস্যু, মেলামাইন, রাইস ব্র্যান্ড, মেহগনি ফলসহ শতাধিক ধরনের পণ্য।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ভারতে আমাদের দেশি পণ্যের কদর বেড়েছে।’ আরও বাড়ার সুযোগ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রেলপথে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হলেও রপ্তানির সুযোগ নেই। পণ্য খালাস করে খালি ট্রেন ফিরে যায় ভারতে। যদি রেলে এসব পণ্য রপ্তানি করা যায়, তবে সময় ও খরচ কমবে এবং নিরাপদে পণ্য পরিবহন সুবিধা পাওয়া যাবে।’
বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৩৯৫ টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৯ টন। রপ্তানি বেড়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৪৪ টন। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য বন্দর দিয়েও আগের চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পাশের দেশ ভারতে ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। একক মাস হিসেবে এটিকে রেকর্ড রপ্তানি বলছেন অনেকে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের জুলাই মাসের চেয়ে ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ভারতে ১২ কোটি ৬১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমিএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ভারতে আমাদের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। অর্ডার বাড়ছে। আমরাও প্রস্তুত।’
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বেশ ভালোভাবেই ভারতের বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা যদি ভারতের বাজার ভালোভাবে ধরতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কেননা, ভারত আমাদের পাশের দেশ, পরিবহন খরচ খুবই কম পড়বে। আমাদের মুনাফা বেশি হবে।
ইপিবি’র দেশভিত্তিক হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, জুলাই মাসে ভারতে ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৭ কোটি ৬৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। বাকিটা পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক দ্রব্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। গত অর্থবছরে ভারতে ১৯৯ কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এরমধ্যে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭১ কোটি ৫৪ লাখ ১০ হাজার ডলার। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ১০ লাখ ২০ হাজার ডলারের। এ ছাড়া কটন ও কটন প্রোডাক্টস থেকে ৩ কোটি ৯২ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং প্লাস্টিক দ্রব্য থেকে ৩ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার এসেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্য বাণিজ্য বেড়েছে ২৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ-ভারত পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৮৭ কোটি ২৯ লাখ ডলার। ওই বছর ১২৭ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতে। দেশটি থেকে আমদানি হয়েছে ৮৫৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের পণ্য।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দুটি দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৮৮ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। ভারতে ১০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হয় ৫৭৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের পণ্য। ওই বছর বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৬৯ কোটি ৭১ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি সই হয়েছিল ১৯৭২ সালে এবং এটি ২০১৫ সালে স্বয়ংক্রিয় ভাবে নবায়ন হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনকে পেছনে ফেলে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানির গন্তব্য হয়েছে বাংলাদেশ।