ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, রিজার্ভের হিসেব বেশি দেখানো হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি আগে থেকে যেভাবে হিসেব হয়েছে সেই পদ্ধতিতেই রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসেবটাই প্রকাশ করা হচ্ছে।
রিজার্ভ নিয়ে কেন এ বিতর্ক? দেশে আসলে রিজার্ভ কত? এ নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসেবের পরামর্শ দিচ্ছে আইএমএফ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের মতো করেই হিসেব করছে। সেই হিসেবে বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসেব পদ্ধতি অনুসরণ করলে যা কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে আইএমএফ। সংস্থাটির সঙ্গে কয়েকটি সেশনে বৈঠক হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, সকালে আইএমএফের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছে। তারা বেশ কয়েকটি সেশনে বিকেল পর্যন্ত বৈঠক করবে। বৈঠকে রিজার্ভসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, সকাল থেকে দিনভর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ছয়টি সেশনে বৈঠক করবে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। এর মধ্যে তিনটি সেশনেই আলোচনা হবে রিজার্ভের হিসেব পদ্ধতি নিয়ে। দলের সদস্যরা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সুশাসন, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবে সংস্থাটি।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসেব হয় আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী।
তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসেব করে বাংলাদেশ। নিট হিসেব থেকে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসেবটাই প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে বিতর্ক চলছে।
এ বিতর্ক শুরু হয় ২০২১ সালে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষা মূল্যায়নের একটি খসড়া প্রতিবেদনে বিদেশি সম্পদের ভুল শ্রেণিকরণ চিহ্নিত করে আইএমএফ। এই ভুল শ্রেণিকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে বলে দাবি করে আসছে আইএমএফ।
পরে গত বছরের ৩ থেকে ১৪ অক্টোবর সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরের সময় হিসেব পদ্ধতি পরিবর্তন করে রিজার্ভের হিসেব করার পরামর্শ দেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে যা সংশোধন করার কথা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও নিজেদের পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
সেই হিসেবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) এর সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) এর আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ।
অর্থাৎ আইএমএফ পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভ হিসেব করলে বর্তমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশ করা মোট ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। এতে রিজার্ভ নেমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। সভার এক ফাঁকে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। আলোচনায় বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। তবে এ ঋণ তিন কিস্তিতে দেওয়া হতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় আইএমএফের প্রতিনিধি দল বুধবার (২৬ অক্টোবর) ঢাকায় এসেছে।
বাংলাদেশের জন্য আগামী ঋণ কর্মসূচি ছাড়াও আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফ’র প্রতিনিধি দলটি ১৫ দিনের সফরে এসেছে। ঢাকায় অবস্থানের সময় অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করবে। এসময় বাংলাদেশের জন্য আগামী ঋণ কর্মসূচি ছাড়াও আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।