নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পোন্নয়ন কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে রড ও সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি টন রডের দাম ৮৮ হাজার টাকা এবং প্রতি বস্তা সিমেন্ট উৎপাদনে ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে বলে জানান উৎপাদনকারীরা। এর আগে এতো দাম দেখা যায়নি কখনই। এ আবস্থায় কোম্পানিগুলো টিকে থাকার স্বার্থে মূল্য সমন্বয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে নির্মাণ কাজের উপকরণ নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া দ্বিগুণ বাড়ায় দেশের বাজারে কাঁচামালের এই অবস্থা।
গত বছরের (২০২১ সাল) নভেম্বরে দেশের বাজারে রডের টন সর্বোচ্চ ৮১ হাজার টাকায় উঠেছিল, যা তখন ইতিহাসের রেকর্ড দাম ছিল। তার আগে ওয়ান/ইলেভেনের (২০০৭-০৮) সরকারের সময় প্রতি টন রডের দাম সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। পক্ষান্তরে, পাইকারি ও খুচরা বাজারে সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি ২০ টাকা বেড়েছে।
সম্প্রতি, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর শিল্পোন্নয়ন কাঁচামালের দাম বাড়ার পালে নতুন করে হাওয়া লাগে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অস্থির আন্তর্জাতিক বাজার। জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন শিল্পপণ্যের কাঁচামালের দাম। জাহাজের জ্বালানি (মেরিন ফুয়েল) টনপ্রতি ৫০ শতংশ বেড়েছে। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে।
নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম প্রধান এই উপকরণটির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে অনেক। এছাড়া ঘাটতিও দেখা দিয়েছে কাঁচামালের। ব্যবসায়ীরা জানান, যেভাবে কাঁচামালের দাম বাড়ছে এবং সংকট দেখা যাচ্ছে, তাতে সামনে আরও দাম বাড়তে পারে। এরই মধ্যে কাঁচামালের ঘাটতির কারণে কমে গেছে উৎপাদন। এদিকে এভাবে দাম বাড়ার ফলে কোনো কোনো ব্যবসায়ী ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছেন না। আবার ক্রেতারা দোকান থেকে কাঁচামাল কেনার সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী।
সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, সিমেন্ট উৎপাদনে প্রধান পাঁচটি কাঁচামাল ক্লিংকার, লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম ব্যবহৃত হয়, যার সবগুলোই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে ৬২ থেকে ৯০ শতাংশই হলো ক্লিংকার। কাঁচামাল ক্লিংকার প্রতি টন ৬০ ডলার থেকে বেড়ে ৭৫-৭৯ ডলার হয়েছে। শুধু ক্লিংকারেই ১৫ ডলারের বেশি দাম বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কাঁচামাল লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম গড়ে ১০-১২ ডলার বেড়ে গেছে। কাঁচামাল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় কয়লা, কয়লার দাম বাড়ায় ও করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় কাঁচামালের সংকট তৈরি হওয়ায় দাম বাড়ছে।
অন্যদিকে রড খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বিএসআরএমের রডের দাম ৮৮ হাজার টাকা, আর বন্দর কোম্পানির রড নিলে সাড়ে ৮৫ হাজার টাকা এবং একেএস রড নিলে সাড়ে ৮৬ হাজার টাকা পড়বে টন। এর নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ ৭ মার্চ ভালো মানের বা ৬০ গ্রেড এক টন রড কোম্পানিভেদে বিক্রি হচ্ছে ৮২-৮৮ হাজার টাকায়। কয়েকদিন আগে যা ৭৬-৮১ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছিল। গত ১০ দিনে প্রায় প্রতিদিনই রডের দাম বেড়েছে। কখনো ৫০০, কখনো এক হাজার টাকা বেড়েছে। এভাবে এখন প্রতি টন রডের দাম ৮৮ হাজার টাকায় উঠেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশের সিমেন্ট ও ইস্পাত শিল্পে অস্থিরতা কারনে কাঁচামালের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে। দেশ থেকে আসা কাঁচামালের দর এরই মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ ছাড়া যুক্ত হয়েছে পণ্য পরিবহন খরচ। এরই মধ্যে ওই সব অঞ্চলে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন কাঁচামালের দাম বাড়লেও, এই পণ্য দেশের বাজারে আসতে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে।