ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন শর্ত দেওয়া হয়েছে। কমানো হয়েছে মুনাফার হার। এর প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে ৩৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে। এ সময় পুরনো সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর এই খাতে সরকারের নিট ঋণ এসেছে ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ কম। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের এসব তথ্য জানা গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছে, অতিমাত্রায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়েছে। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধান করা হয়েছে। এ কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ কমিয়েছেন।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের নিট ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। প্রথম চার মাসে অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ২৯ শতাংশ ঋণ নিয়েছে সরকার।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের একক মাস অক্টোবরে মোট ৮ হাজার ৭২৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে। এর মধ্যে মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ হয়েছে ৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। মূল অর্থ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থ নিট বিক্রি হিসেবে গণ্য হয়। সেই হিসেবে আলোচিত সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ৭৬৬ কোটি টাকা।
একদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। অন্যদিকে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সুদ পরিশোধসহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় বেড়েছে। ফলে রাজস্ব আয় ও বিদেশি অর্থ ছাড় বাড়লেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।
বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্র থেকে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা নিট ঋণ নেয় সরকার। যেখানে গত অর্থবছরে মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ দিকে এ খাতের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়।
ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার অনেক বেশি ঋণ আসায় চলতি অর্থবছরে এ খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। তবে সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের অঙ্কের ওপর ভিত্তি করে সরকার মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ করায় এ খাতের বিনিয়োগ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
এই মুহূর্তে ঘাটতি মেটাতে সরকার আবার ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের কোনো ব্যাংকঋণ ছিল না। ওই সময়ে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল।
সম্প্রতি সময়ে বেশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে সরকার। চলতি বাজেটে দুই লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র মিলবে শুধু সঞ্চয় অধিদফতরের।
সব শেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার ওপরে বিনিয়োগের মুনাফার হার দুই শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকার নিচে মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন নির্দেশনা অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যারা সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ৩০ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ৯ শতাংশ হারে।
এখন থেকে যারা সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এত দিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা দেওয়া হতো। এখন এ সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে এ হার হবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। পাঁচ বছর মেয়াদি এ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখন এ সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ হার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মুনাফার হারে পরিবর্তন আনা হয়নি। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার সাড়ে ৭ শতাংশ। এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার সাড়ে ৭ শতাংশ। এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।