সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় ইতোমধ্যে ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ‘খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংক থেকে পুরো টাকাই উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন আমজাদ। কাগুজে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিক তিনি নিজেই। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ‘রূপসা ফিশ কোম্পানি’ নামে অপর এক প্রতিষ্ঠানের ৩৭৪ কোটি টাকার ঋণপত্র লুটপাটের অভিযোগ।
বিদেশেও অর্থপাচার করেছেন এসবিএসির সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন। দুদকের কাছে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের কলকাতায় আত্মসাৎ করা অর্থের বড় একটি অংশ পাচার করেছেন। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্র যাচাই-বাছাই করছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার বলেন, এসবিএসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনসহ সাতজনকে আসামি করে গতকাল বৃহস্পতিবার মামলা দায়ের হয়েছে। তদন্ত কাজ চলমান। এছাড়া আরও বেশকিছু অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অর্থপাচারের বিষয় নিয়ে এখনও বলার মতো সময় আসেনি।
খুলনা অঞ্চলের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘লকপুর’ গ্রুপের মালিক এস এম আমজাদ হোসেন। তার মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেড’ অন্যতম। ওই প্রতিষ্ঠানের ঋণ জালিয়াতিতে মামলাটি হয়েছে।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০১০ সালের ৮ আগস্ট রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস থেকে খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির ৫১ শতাংশ শেয়ার আমজাদ হোসেন এবং ৪৯ শতাংশের মালিকানা তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের। খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুফিয়া আমজাদ হলেও মূলত ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেনের একক স্বাক্ষরে সবকিছু পরিচালনা হতো। মঞ্জুরি করা ঋণের অর্থ তার স্বাক্ষরেই তোলা হয়।
ঋণ জালিয়াতির ওই ঘটনার শুরু ২০১৬ সালে। ওই বছরের ১ জুন জামানত ছাড়া খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেডের অনুকূলে ১৯ কোটি টাকা এসওডি (জেনারেল) ঋণসীমা প্রদানের জন্য সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের খুলনা শাখায় আবেদন করেন আমজাদ হোসেন। ১২ শতাংশ সুদে আমজাদের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাচাই না করে, ভুয়া ভিজিট রিপোর্ট প্রস্তুত করে এবং গ্রাহকের প্রদেয় স্টক লটের বাস্তবতা যাচাই ছাড়াই আবেদনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রপোজাল তৈরি করেন খুলনা শাখার কর্মকর্তা এমটিও তপু কুমার সাহা। যেখানে ওই শাখার সিনিয়র অফিসার বিদ্যুৎ কুমার মন্ডল, এফএভিপি ও অপারেশন ম্যানেজার মোহা. মঞ্জুরুল আলম এবং ভিপি ও শাখাপ্রধান এস এম ইকবাল মেহেদী সুপারিশ করেন।
২০১৬ সালের ২ জুন ৪৮তম পরিচালনা পর্ষদের সভায় খুলনা বিল্ডার্সের অনুকূলে ১৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকার এসওডি ঋণ অনুমোদিত হয়। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের পর ওই বছরের ২ জুলাই খুলনা শাখা থেকে ১৫ কোটি টাকা তোলা হয়। ২০১৭ সালের ৫ আগস্ট ঋণের সীমা ১৫.৫৩ কোটি থেকে ২২.৪২ কোটি টাকা বাড়ানোর আবেদন করা হয়। এবারও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোনো প্রকার ক্রেডিট মিটিং ছাড়াই ৬৬তম সভায় (৮ আগস্ট) ঋণসীমা ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা করে নেন তিনি।
অথচ প্রতিষ্ঠানটি ছিল অস্তিত্বহীন। খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেডের ঠিকানায় দুদক একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অস্তিত্ব পায়। এর পাশের প্লটে হোটেল ওয়েস্টার্ন ইন ইন্টারন্যাশনাল অবস্থিত। দুদকের সার্বিক পর্যালোচনায় ‘খুলনা বিল্ডার্স’ নামসর্বস্ব ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়। ভুয়া ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। যার মূল কারিগর আমজাদ হোসেন। তিনি শুধু অর্থ আত্মসাৎ করেননি, ঋণের সমুদয় অর্থ আড়াল করে গতিপথ পাল্টানোর চেষ্টাও করেন।
মামলায় আমজাদ হোসেন ছাড়াও ব্যাংকটির ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহা. মঞ্জুরুল আলম, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শাখা প্রধান এস এম ইকবাল মেহেদী, এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ক্রেডিট ইনচার্জ মো. নজরুল ইসলাম, ব্যাংকটির খুলনার শাখার সাবেক এমটিও ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার তপু কুমার সাহা, সিনিয়র অফিসার বিদ্যুৎ কুমার মন্ডল, সিনিয়র অফিসার মারিয়া খাতুনকে আসামি করা হয়েছে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আমজাদ হোসেন।
এর আগে ৫ জানুয়ারি ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে আমজাদ হোসেনের নামে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে বলা হয়, আমজাদ হোসেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের শেয়ারসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করছেন। এসব অর্থ অবৈধ প্রক্রিয়ায় দেশের বাইরে পাচারের চেষ্টা করছেন, যা মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে এস এম আমজাদ হোসেন, স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ ও মেয়ে তাজরির বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।
দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ’ আত্মসাতের অভিযোগে এস এম আমজাদ হোসেনের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এর আগেও তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমা হয় দুদকে।
এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আমজাদ হোসেন, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল ইসলাম ও সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে অধিকাংশ অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
বিভিন্ন সময়ে দুদকে আসা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, আমজাদ হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের খুলনা সদর ও কাটাখালী শাখা ব্যবহার করে আমদানি-রফতানি ও ঋণের আড়ালে নানাবিধ দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতির মাধ্যমে আমানতকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
খুলনা অঞ্চলের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান লকপুর গ্রুপের মালিক এস এম আমজাদ হোসেন। তার মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- লকপুর ফিশ প্রসেস কোম্পানি লিমিটেড, বাগেরহাট সিফুড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, শম্পা আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, রূপসা ফিশ অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, মুন স্টার ফিশ লিমিটেড।
এছাড়া খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, খুলনা এগ্রো এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড, ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেড, মেট্রা অটো ব্রিকস লিমিটেড, খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেডসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ শিল্প গ্রুপে।