ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রাজধানীর মানিকনগর এলাকার সাইফুল ইসলাম একসময় চাকরি হারিয়ে গলির মোড়ে ঘড়ি মেরামতের দোকান দেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তার সামান্য আয় দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালিয়ে নিতে পারছেন না তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ জনের সংসারের মাসিক খরচ ২৭-২৮ হাজার টাকা, যার মধ্যে শুধু খাবারের খরচই ১০ হাজার টাকা। সংসারের এই চাপ সহ্য করতে, ছেলে স্কুল ছেড়ে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন এবং মেয়ে টিউশনি করছেন। তা সত্ত্বেও পরিবারের চাহিদার বিপরীতে সীমিত আয় দিয়ে গত এক বছরের মূল্যবৃদ্ধির দ্বৈরথে পেরে উঠছে না সাইফুলের সংসার। এই চিত্র সারাদেশে কোটি সাইফুলের পরিবারেই।
২০২৪ সালে মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। সরকারি ক্রয়-বিক্রয়কারী সংস্থা টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাইফুলের মতো পরিবারগুলো এখন ১০০ টাকার চালের জন্য ১১৭ টাকা দিতে বাধ্য। শুধু চাল নয়, ভোজ্যতেল, ডিম, আলু, পেঁয়াজসহ প্রায় সব পণ্যের দামই বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে।
২০২৪ সালে আলু ও পেঁয়াজের দাম ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বেশি। বছরের বেশির ভাগ সময় আলুর দাম প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা থাকলেও গত পাঁচ বছরে এবারই প্রথম পুরোনো আলুর দাম কেজিতে ৭৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পেঁয়াজের দামও ছিল রেকর্ড পর্যায়ে। যদিও বর্তমানে কিছুটা কমেছে, তবে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা ২০১৯ সালের পর সর্বোচ্চ। এ বছরের সবচেয়ে প্রভাবিত সেক্টর ছিল ডিম ও মুরগির দামও। বিশেষত অক্টোবর মাসে ডিমের দাম প্রতিটি ১৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়, যা সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, এখনো গত বছরের তুলনায় ডিমের দাম ৪ শতাংশ বেশি রয়েছে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবমতে, বিদায়ী ২০২৪ সালে খাদ্যমূল্য গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। অথচ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব বলছে, একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মোট আয়ের ৬০ শতাংশ অর্থই খাবারের পেছনে খরচ করতে হয়। এর সঙ্গে খাদ্যবহির্ভূত খরচের বাড়তি বোঝা তো রয়েছেই।
বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩.৮০ শতাংশ। যদিও জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, নভেম্বরে তা কিছুটা কমেছে, তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১.৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মানে, গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যা কেনা যেত, চলতি বছরের নভেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এ অবস্থায় মানুষের আয় বেড়েছে সীমিত ভাবে, বিশেষত নিম্নআয়ের মানুষের আয় বৃদ্ধি ছিল খুবই কম।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে মাত্র ৭.৫২ শতাংশ, অর্থাৎ গত বছর যেখানে একজন শ্রমিক ১০০ টাকা আয় করতেন, সেখানে এই বছর তার আয় হয়েছে ১০৭.৫০ টাকা।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের ক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, একসময় যখন পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যাওয়া হতো, তখন ব্যাগ ভর্তি পণ্য নিয়ে বাসায় ফেরার আনন্দ ছিল। কিন্তু এখন পকেট ভর্তি টাকা নিয়েও সেই পুরোনো বাজারের মতো অনেক কিছুই কেনা সম্ভব হয় না।
বিশ্লেষকদের মতে, পণ্যের দাম বাড়লে প্রথমে প্রভাব পড়ে দরিদ্র ও দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি থাকা মানুষের ওপর। এতে কিছু মধ্যবিত্তও নতুন করে দারিদ্র্যসীমার দিকে চলে আসে। মূল্য বৃদ্ধির ফলে তারা খরচ কমাতে খাবারের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য কমায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে অপুষ্টি এবং শিশুদের মেধার উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে মানুষের আয় বাড়েনি এবং সঞ্চয় নেই, ফলে খাদ্যের চাহিদা তেমন বাড়েনি। তবু পণ্যের দাম বেড়েছে, যা গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য কষ্টকর। এর কারণ, মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো, ডলার-সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে।
০৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অনেকে আশা করেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ফেরাবে। তবে শুল্ক কমানোসহ সরকারের পদক্ষেপের পরও পণ্যের দাম কমার পরিবর্তে আরও বেড়েছে এবং রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, পূর্ববর্তী সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় দাম বেড়ে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারও তা প্রতিরোধে সক্ষম হয়নি। বাজার সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। শুল্ক কমিয়ে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হলেও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে তার সুফল ভোক্তারা পাননি। ঢাকা পোস্ট।