ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারের চিত্র পাল্টাল না। এখনও বাজার সিন্ডিকেটকারীরা আগের মতোই বহাল। কোনো পণ্যেরই তেমন কোনো ঘাটতি না থাকলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দফায় দফায় পণ্যমূল্য বাড়িয়েই যাচ্ছে। প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। শুল্ক কমালেও আলু এখনও ৬০-৬৫ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে পেঁয়াজের কেজিও ১২০ টাকা। ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর ডজনে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসলেও পণ্যমূল্য না কমায় হতাশা ব্যক্ত করছেন ক্রেতা-ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা।
বাজারে যে সিন্ডিকেট এখনও বহাল তা ইলিশের বাজারের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। দেশে এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ইলিশের দাম কম থাকে। অথচ এবার ভরা মৌসুমেও দাম অনেক চড়া। এই অবস্থায় যে দিন সরকার ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির ঘোষণা দেয়, ঠিক তার পরের দিনই ইলিশের দাম কেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে যায়। অথচ তখনও পর্যন্ত কেবল ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, একটি ইলিশও তখনও রপ্তানি করা হয়নি। এই যে এক দিনের ব্যবধানে ইলিশের কেজি ২০০-৩০০ টাকা বেড়ে গেল-এটা কি বাজার সিন্ডিকেট না? এ প্রশ্নই তুলছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এদিকে ভোক্তারাও বলছেন, সরকারের পরির্তন হলেও বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ এখনও আমাদের চোখে পড়ছে না। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ক্রেতা আনিসুর রহমান বলেন, যারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তারাও এখন খোলস বদল করেছে। সরকার কয়েকটি পণ্যের শুল্ক কমিয়েছে, বাজারে তারও কোনো প্রতিফলন নেই। এর সুফলও ভোক্তা পাচ্ছে না ওই বাজার সিন্ডিকেটের কারণে। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার বাস্তবায়ন যেসব সরকারি সংস্থা করবে সেগুলোতেও এখনও বসে আছে আগের সরকারের লোকেরা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা সরকারকে সহযোগিতা করছে না। সরকার পলিথি বন্ধের মনিটরিং জোরদার করছে, কিন্তু বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এখন কথা হচ্ছে, পলিথিন নিয়ন্ত্রণ করা আগে জরুরি, নাকি বাজার মনিটরিং বাড়িয়ে চড়া পণ্যমূল্য কমিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া বেশি জরুরি।’
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘আগের সরকারের আমলে লুটেরা ব্যবসায়ীরা লুটপাটের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের পকেট খালি করেছে। এ জন্য দীর্ঘ দিন মানুষ উচ্চ পণ্যমূল্যের কশাঘাতে নিষ্পেষিত হয়েছে। ওই পরিস্থিতি থেকে পরত্রাণ চাইছিল দেশের মানুষ। ৫ আগস্টের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের কাছে অনেক প্রত্যাশা দেশের মানুষের। মানুষ ভেবেছিল এবার হয়তো মুক্তি মিলছে চড়া পণ্যমূল্য থেকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পণ্যমূল্য কমাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি। সরকারের বয়স ৫৩ দিন পার হয়েছে, বাজারের চিত্র কিন্তু পাল্টাল না। দাম না কমে উল্টো চাল, ডিম, সবজিসহ অনেক পণ্যের দাম আরও বেড়ে গেছে। এভাবে চললে কিন্তু আগের সরকারের ওপর যেভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল, এখনও সেভাবে হতে পারে। তাই সরকারকে এখন সবার আগে দেশের সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে দ্রব্যমূল্য কমাতেই হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের তরফ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে। যেমন মিল মালিক বা ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কি পণ্য আনছে, কত দামে আনছে এবং কত দামে বিক্রি করছে সে বিষয়ে গাইডলাইন দিতে হবে। একইভাবে পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীর জন্য সুস্পষ্ট গাইডলাইন করে দিতে হবে সরকারকে। শুধু গাইডলাইন দিলেই হবে না সেটি ব্যবসায়ীরা মানছে কি না, প্রতিদিন মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ডিম আমদানি করছে, কারা গম আমদানি করছে, কারা চিনি আমদানি করছে, তাদের বিষয়ে সব তথ্য নিতে হবে সরকারকে এবং তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।’
বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ০৫ আগস্টের পর সপ্তাহখানেক সারা দেশের বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য কিছুটা কমে এসেছিল। এর পেছনে কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, পণ্যবাহী ট্রাকে এবং বাজারগুলোতে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীরাও কিছুটা আতঙ্কে ছিল কারসাজি করলে হয়তো সরকার ছাড় দেবে না। কিন্তু দিন দশেক পর থেকেই বাজারের চিত্র আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ আবারও চাঁদাবাজি শুরু হয়ে যায় এবং ব্যবসায়ীরাও দেখেছে যে, সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে বেশি ব্যস্ত, বাজারের দিকে কোনো নজর নেই। ব্যবসায়ীরা বুঝে নিয়েছে যে, সরকার তেমন কোনো কিছুই করবে না। তাই আবার আগের মতোই ফ্রি সটাইলে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে লুটপাট শুরু করেছে।
সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে যেভাবে
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সবার আগে উৎপাদক বা মিল পর্যায়ে, পাইকারি পর্যায়ে এবং খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা কি দামে পণ্য কিনছে আর কত দামে বিক্রি করছে সে বিষয়টি সরকারকে জানতে হবে। এটা জানার পর ব্যবসায়ীরা সহনীয় হারে লাভ করছে, না কি অস্বাভাবিক হারে লাভ করছে সেটি দেখতে হবে। যে ব্যবসায়ী অস্বভাবিক লাভ করবে তাকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আইন করে দেশে ডিওপ্রথা বাতিল করা হলেও এখনও এসও প্রথার নামে আসলে ডিওপ্রথার মাধ্যমেই মিল ও পাইকারি পর্যায়ে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই ডিওপ্রথা বা এসও-প্রথার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। খুচরা ও পাইকারি দোকানগুলোতে ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ রাখার যে বিধান রয়েছে সেটি শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাজার অভিযানে যদি একই ব্যবসায়ী বা একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বারবার অপরাধের প্রমাণ মেলে তা হলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, দরকার হলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে।
কি করছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো
দ্রব্যমূল্য কমাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন কোনো ভূমিকা এখন চোখে পড়ে না। এর পেছনে প্রধান দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও আগের সরকারের বসানো লোকজনই রয়েছে। তারা বর্তমান সরকারকে ঠিকমতো সহযোগিতা করছে না। দ্বিতীয়ত, ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সরকারি যেসব সংস্থা বাজার মনিটরিং করত তারা পুলিশ বা র্যাব বাহিনীর সহযোগিতা নিত। কিন্তু এখন অভিযানের জন্য চেয়েও পুলিশ পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা এক রকম থমকে গেছে।
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের ভালো ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি জনবল সংকটে রীতিমতো ধুঁকছে। কমিশনের চেয়ারম্যানের পদটিই এখন ফাঁকা পড়ে আছে। এছাড়া সদস্যরাও সবাই নেই।
এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এর আগে আমরা বাজার সিন্ডিকেটের প্রমাণ মেলায় ৬ প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করেছিলাম। এখনও কিছু পণ্য নিয়ে কাজ করছি। তবে আমাদের জনবল সংকটের কারণে কাজে গতিশীলতা আনা যাচ্ছে না। আশা করছি কমিশনের চেয়ামর্যানসহ অন্যান্য জনবল বাড়লে আমরা আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারব বাজারে। সময়ের আলো।