ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সয়াবিন তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। বর্তমানে বিশ্ব বাজারে প্রতি মেট্রিক টনের দাম এক হাজার ১৩০ ডলার। ২০২৫ সালে এটি বেড়ে দাঁড়াবে এক হাজার ১৫০ ডলারে। একই ভাবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে অন্য নিত্যপণ্যগুলোর দাম কেমন যাবে, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বিশ্ব ব্যাংক।
সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় ওয়াশিংটন থেকে সম্প্রতি ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ নামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ১০০টি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে কিছু পণ্যে স্বস্তির বার্তা দিলেও অস্বস্তির বার্তাও আছে কিছু পণ্যে। তবে এসব পণ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একান্তই অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, জ্বালানি তেল ও তুলার মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। ফলে বাংলাদেশের বাজারে এসব পণ্যে দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়বে। তবে ইউরিয়া সার ও এলএনজির দাম নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বস্তির খবর দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
চলতি বছর বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম সার্বিকভাবে ৩ শতাংশ কমবে। আর ২০২৫ সালে পণ্যের দাম কমবে ৪ শতাংশ- বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে পারে বলে মনে করে এ বৈশ্বিক সংস্থাটি। তবে স্থানীয় উৎপাদনের বাইরে কোন দেশ কী ধরনের পণ্য কী পরিমাণ আমদানি করে- তার ওপর মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নির্ভর করবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ১০০টি অতি প্রয়োজনীয় ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম আগামী দুই বছরে কতটা বাড়তে পারে বা কতটা কমতে পারে, সেই পূর্বাভাসও দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা পণ্যের তালিকা ধরে বাংলাদেশ যে ১০টি নিত্যপণ্য তুলনামূলকভাবে বেশি আমদানি করে, তা পর্যালোচনা করা হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে সংস্থাটির বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট আমি দেখেছি। এটি একটি ভবিষ্যদ্বাণী। ওভারঅল ৩ শতাংশ নিত্যপণ্যের দাম কমবে বলে এমন একটি পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। যেসব পণ্যের দাম কমবে তার মধ্যে গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল রয়েছে।
রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষায় ৬৬৮ কোটি টাকা দেবে বিশ্ব ব্যাংক
‘আমরা সাধারণত পরিশোধিত তেল বেশি আমদানি করি। অপরিশোধিত তেলের দাম কমলে পরিশোধিত তেলের দামও কমার কথা। এটি ভোক্তা পর্যায়ে কতটুকু প্রভাব ফেলবে পলিসিরও বিষয় আছে। এতে ইমপোর্টার (আমদানিকারক) লাভবান হবেন। ইমপোর্ট কস্ট (আমদানি ব্যয়) কমবে। ভোক্তারা উপকৃত হবেন কি না তা বলা যাবে না। কারণ, তেলের দাম কতটা কমবে সেটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পলিসির ওপর নির্ভর করবে। বিপিসি যদি বলে তারা পলিসি পরিবর্তন করবে না তবে ভোক্তারা লাভবান না হয়ে বিপিসি লাভবান হবে।’
তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিখাতে অনেক পণ্য আমদানি হয়। নিত্যপণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব আছে। এতে ভোক্তা পর্যায়ে সুবিধা মিলবে না। এটি মূলত প্রতিযোগিতার অভাবের কারণে হবে। কতটা কমবে তা বলা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো কমবেও না।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যে। ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবে যথেষ্ট ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য। চলতি বছরের এপ্রিলের গোড়ার দিকে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৯১ ডলার হয়েছিল। সোনার দামের ক্ষেত্রেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সারের দামে সুখবর মিলবে ২০২৫ সালে। ইউরিয়া সারের দাম বর্তমানে টনপ্রতি ৩৫৮ ডলার থেকে কমে ৩৫০ ডলার হতে পারে। ২০২৫ সালে টনপ্রতি আরও কমে ৩২৫ ডলার হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছর প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার সার আমদানি হয়েছে। ডিএপি সার বর্তমানে টনপ্রতি দাম ৬০০ ডলার, ২০২৫ সালে কমে ৫৫০ ডলার হবে। টনপ্রতি বর্তমানে টিএসপির দাম ৪৫০ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ৩৮০ ডলার। তবে দাম বাড়বে ফসফেট সারের। কৃষকের ফসল সবুজ ও সতেজ করতে এই সারের গুরুত্ব অনেক। টনপ্রতি বর্তমানে ফসফেট রকের দাম ২৬৬ ডলার, ২০২৫ সালে দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৩২২ ডলার।
দাম কমবে কয়লা-এলএনজির
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, কয়লার দাম ব্যাপক কমতে পারে। ২০২৩ সালে প্রতি টন কয়লার গড় দাম ছিল প্রায় ১৭৩ ডলার। চলতি অর্থবছর এর গড় দাম হতে পারে ১২৫ ডলার, ২০২৫ সালে আরও কমে দাঁড়াবে ১১০ ডলারে।
অন্যদিকে প্রতি বিএমএমটিইউ এলএনজির দাম ১৪ ডলার থেকে কমে সাড়ে ১২ ডলার হতে পারে।
খাদ্যপণ্যেও সুখবর
কমতে পারে কফি, চিনি, গম ও ভুট্টার দাম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি কেজি কফির (অ্যারাবিকা) দাম ৫ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ৪ ডলারে। কিছুটা বাড়বে চায়ের দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি চায়ের দাম গড়ে ২ দশমিক ৭৫ ডলার, ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৭৭ ডলারে। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন ভুট্টার দাম ২০০ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ১৯৬ ডলারে। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন গমের দাম ২৯০ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ২৮৫ ডলারে। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন জবের দাম ১৯৬ ডলার হলেও পরবর্তী বছর কমে ১৮৫ ডলার হবে।
পেট্রোল অকটেন ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়লো
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০২৩ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি সাড়ে ৮২ ডলার। চলতি বছর তা বেড়ে ৮৪ ডলার হতে পারে। তবে আগামী বছর তা কমে ৭৯ ডলার হতে পারে। জ্বালানি তেল আমদানিতেই সরকার সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষের হিসাবে ৪৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, এ বছর এ খাতে খরচ আরও বাড়তে পারে।
সয়াবিনের বাড়লেও কমবে পাম অয়েলের দাম
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সয়াবিন তেলের দাম বাড়লেও কমবে পাম ও নারিকেল তেলের দাম। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন তেলের দাম ১ হাজার ১৩০ ডলার, ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ১৫০ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন তেলে বাড়বে ২০ ডলার।
বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন নারিকেল তেলের দাম ১ হাজার ১৮৫ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ১ হাজার ১০০ ডলার। দেশের বাজারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পাম অয়েল। ২০২৪ সালে গড়ে প্রতি মেট্রিক টন পাম অয়েলের দাম ৯০৫ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ৮২৫ ডলারে। ফলে ব্যাপকভাবে কমবে পামওয়েলের। দাম কমবে সয়াবিন মিলের। ২০২৪ সালে প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন মিলের দাম ৪৮০ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ৪৬০ ডলারে।
বিশ্ব বাজারে স্বস্তি নেই গরু-মুরগির মাংসে
বিশ্ব বাজারে স্বস্তি নেই মাংসের দামে। মুরগি ও গরুর মাংসের দাম আরও বাড়বে। বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৫ দশমিক ২০ ডলার, ২০২৫ সালে দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৩০ ডলার। ফলে এক বছরের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম ২০ সেন্ট বাড়বে। মুরগির মাংসের দামও প্রতি কেজিতে ৩ সেন্ট বেড়ে ২০২৫ সালে হবে ১ দশমিক ৫৩ ডলার। তবে প্রতি কেজি কলার দাম ৪ সেন্ট কমে ২০২৫ সালে হবে ১ দশমিক ৬১ ডলার। চিংড়ির দামও ৫০ সেন্ট বেড়ে ২০২৫ সালে ১০ ডলার।
বাংলাদেশকে ৪৯৫ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস দিতে চায় ব্রাজিল
দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ আমদানি পণ্য তুলা। এটি বস্ত্র খাতের মূল কাঁচামাল। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, আগামী দুই বছর তুলার দাম বাড়বে। এ বছর প্রতি কেজি তুলার দাম উঠতে পারে ২ দশমিক ১৫ ডলারে। আগামী বছর তা আরও ৫ সেন্ট বাড়তে পারে। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের তুলা আমদানি হয়েছে। একইভাবে এলএনজি এবং কয়লার দামও কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
স্বস্তি মিলছে সোনার দামে
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে সুখবর মিলেছে সোনার দামে। ২০২৪ সালে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম এখন গড়ে ২ হাজার ১০০ ডলার, ২০২৫ সালে কমে দাঁড়াবে ২ হাজার ৫০ ডলারে। ফলে বছরের ব্যবধানে প্রতি আউন্স সোনায় দাম কমবে ৫০ ডলার। তবে সিলভার ও প্লাটিনামের দাম বাড়বে।
কমবে রড তৈরির উপকরণের, বাড়বে টিনের দাম
চলতি বছরের থেকে ২০২৫ সালে সুখবর মিলবে রড তৈরির উপকরণ আকরিক লোহার দামে। প্রতি ড্রাই মেট্রিক টন আকরিক লোহার দাম এখন ১১০ ডলার, ২০২৫ সালে তা কমে দাঁড়াবে ১০৫ ডলারে। এই কাঁচামাল রড তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। বাড়বে টিনের দাম। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন টিনের দাম ২৭ হাজার ডলার, ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২৮ হাজার ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে প্রতি টনে বাড়বে ১ হাজার ডলার। প্রতি টন অ্যালুমিনিয়ামের দাম ১০০ ডলার বেড়ে দাঁড়াবে ২ হাজার ৪০০ ডলার।
দাম বাড়বে বেভারেজ পণ্যের
বর্তমানে প্রতি কেজি বেভারেজের দাম ২ দশমিক ৭৫ ডলার। ২০২৫ সালে ২ সেন্ট বেড়ে ২ দশমিক ৭৭ ডলার হবে। কমবে কফির দাম। প্রতি কেজি কফির দাম ৫ সেন্ট কমে ৪ দশমিক ৩৫ ডলার হবে। প্রতি কেজি চায়ের দাম বছর ব্যবধানে ২ সেন্ট বেড়ে ২ দশমিক ৭৭ ডলার হবে।
বিশ্ব বাজারে দাম কমলেও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে না বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। তবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) দাবি বাংলাদেশ বিশ্বের বাইরে নয়। সুতরাং বিশ্ব বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে দেশে যেমন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, বিশ্ব বাজারে দাম কমলে দেশেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এফবিসিসিআই পরিচালক খান আহমেদ শুভ বলেন, আমরা পৃথিবীর বাইরের কোনো দেশ নই। সুতরাং বিশ্ব বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে আমাদেরও সমন্বয় করতে হয়। আবার কোনো পণ্যের দাম কমলে আমরাও কমাই। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসাবান্ধব। জিনিসপত্রের দাম যেন নাগালের মধ্যে থাকে এ বিষয়ে তিনি আমাদের বার বার দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। সুতরাং বিশ্ব বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমলে আমরাও কমাবো। জাগো নিউজ।