ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশে বেশ কিছু অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের চাহিদা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। গম, ভুট্টা, কয়েক পদের ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, জিরা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। গত বছর থেকে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে আলু। সবশেষ অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এমন ১১টি কৃষিপণ্যের মধ্যে ছয়টির আমদানি বেড়েছে, কমেছে পাঁচটির।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বিগত চার অর্থবছরের আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া যায়। যদিও গত অর্থবছরের প্রায় পুরোটা সময় ডলার সংকটে ঋণপত্র (এলসি) খোলার সমস্যায় আমদানি কমার কথা বলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি সংকটের কারণে গত অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত এসব পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে।
তথ্য বলছে, গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) দেশে গম, মসুর ডাল, রসুন, হলুদ, জিরা ও আলুর আমদানি বেড়েছে। আর কমেছে ভুট্টা, ছোলা, মুগডাল, পেঁয়াজ ও আদার আমদানি।
বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গম আমদানি
গত অর্থবছর অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেড়েছিল গম আমদানি, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৬ লাখ ৬২ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৬ লাখ টন বেশি। ওই অর্থবছর (২০২২-২৩) আমদানির পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ ২৫ হাজার টন। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৫ লাখ ৭৯ হাজার টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৪ লাখ ৫৩ হাজার টন গম আমদানি হয়।
যদিও এ তথ্যের সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গম আমদানির তথ্যের কিছুটা ফারাক রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮ লাখ ৭ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে বলে তথ্য দিচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে ৭ লাখ ৮৩ হাজার টন। বাকি ৬০ লাখ ২৪ হাজার টন আমদানি করেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
দুই মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেড় লাখ টন গম আমদানির ফারাক থাকলেও এটা প্রমাণিত যে, গত অর্থবছর দেশে গম আমদানির হিড়িক পড়েছিল। যদিও আমদানি ও বিশ্ববাজারে গমের দাম কমার তুলনায় দেশে আটা-ময়দার দাম সমন্বয় সেভাবে হয়নি।
রেকর্ড উৎপাদনের পরেও দেশে বাড়ছে চা আমদানি, কমছে রপ্তানি
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দাম কম থাকায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রচুর গম আমদানি করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি সরকারও এসময় রাশিয়া থেকে গমের একটি বড় চালান কিনেছে। এছাড়া ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও উরুগুয়ে থেকে গম কেনা হচ্ছে। ওইসব দেশ থেকে ২২৭ থেকে ২৪০ ডলারের মধ্যে প্রতি টন গম কেনা যাচ্ছে, যা আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
গম আমদানি প্রসঙ্গে দেশের অন্যতম নিত্যপণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছিল গত ফেব্রুয়ারি থেকে। যে কারণে আমদানি বেড়েছে। এর আগে কয়েক বছর বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পরে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে বেশ কয়েক বছর গম আমদানি নেতিবাচক ছিল।’
বেড়েছে হলুদ-জিরার আমদানি
গত অর্থবছর ৩০ হাজার ৯১ টন হলুদ ও ৩৩ হাজার ১৩০ টন জিরা আমদানি হয়েছে। এসময় পণ্য দুটির আমদানি বেড়েছে আগের অর্থবছরের চেয়ে যথাক্রমে প্রায় আড়াই হাজার ও আট হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে হলুদের আমদানি ছিল ২৭ হাজার টন ৬৯৩ টন ও জিরার ২৫ হাজার ২৮০ টন।
আলু আমদানিতে নতুন ইতিহাস
গত তিন বছর আগেও আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল বেশি। এমনও হয়েছে, বাড়তি আলু পঁচে নষ্ট হয়েছে হিমাগারে। সে সময় দাম পায়নি চাষি।
চাহিদার বাড়তি আলু রপ্তানি হতো বিশ্বের ১৬টি দেশে। তিন বছর আগে (২০২০-২১) দুই লাখ টন আলু রপ্তানির রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। এরপর দুই বছর কিছুটা কমে। এখন ঘাটতি পূরণে আলু আমদানি হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে গত অর্থবছর থেকে প্রথম খাওয়ার আলু আমদানি হয়েছে। আগে মূলত উৎপাদনের জন্য কিছু আলুবীজ আমদানি হতো।
অস্থির পেঁয়াজের বাজার, এবার কোথায় গিয়ে ঠেকবে দাম?
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু আমদানি হয়েছে ৯৭ হাজার ২১৯ টন। একই সময়ে আলু রপ্তানি হয়েছে ১২ হাজার ৩৫২ টন। অর্থাৎ, রপ্তানির প্রায় আটগুণ আলু আমদানি হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে আলুর দাম বাড়তে থাকায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রথমবার আলু আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ২ নভেম্বর বাণিজ্যিকভাবে আলু আমদানি শুরু হয়। গত নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৭১ টন আলু আমদানির অনুমতি বা আইপি ইস্যু করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট উইং। চলতি (জুলাই) মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত আইপি দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার মেট্রিক টনের, এর মধ্যে এসেছে ২৫ টন।
ডালের আমদানি মিশ্র
গত বছর রমজানে দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল মসুর ডালের দাম, যা এখনো বাড়তি। ওই সময় ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, ডলার সংকটে মসুর ডালের আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।
তবে অর্থবছর শেষে দেখা যাচ্ছে, মসুর ডালের আমদানি অন্য বছরের তুলনায় বেড়েছে। তথ্য বলছে, দেশে গত অর্থবছর ৫ লাখ ২৯ হাজার টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার টন। এছাড়া ২০২১-২২ এ দেশে ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৩ লাখ ১৮ হাজার টন মসুর ডাল আমদানি হয়।
দেশে বর্তমানে সব ধরনের মিলে বার্ষিক ডালের চাহিদা প্রায় ২৬ লাখ টন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ টন। এর মধ্যে মসুর ডালের চাহিদা কত তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে প্রতি বছর বিদেশ থেকে বিভিন্ন পদের প্রায় ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন ডাল আমদানি করে সরকার। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৬-৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ছোলাও রয়েছে।
বিগত বছর ছোলার আমদানি কমেছে। গত অর্থবছর আমদানি হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টন। যেখানে তার আগের অর্থবছর ছিল ৩ লাখ ২ হাজার টন। এছাড়া ২০২১-২২ এ ৩ লাখ ৭৬ হাজার টন ও ২০২০-২১ অর্থবছর ১ লাখ ৩৮ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়।
একই ভাবে মুগডালেরও আমদানি কমেছিল শেষ অর্থবছরে। এসেছিল মাত্র ৬ হাজার ৮৯৫ টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১ লাখ টনের বেশি কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর আমদানি ছিল ১ লাখ ৭ হাজার টন।
গত অর্থবছরে ডাল আমদানি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, ‘মসুর ডালের সংকট না থাকলেও অ্যাংকর, মটরসহ অন্য ডাল এখনো আমদানি কম হচ্ছে। যে কারণে মসুর ডালের দামেও সে প্রভাব পড়েছে। মোটাদাগে সব ধরনের ডালের দাম বেড়েছে আমদানির কারণে।’
ভুট্টা আমদানি নগণ্য
দুই যুগ আগেও দেশে ভুট্টা খুব বেশি প্রয়োজনীয় ফসল ছিল না। মানুষের পাশাপাশি সামান্য পশুখাদ্য হিসেবে ভুট্টার চাষাবাদ হতো। সেই ভুট্টা চাষে কম সময়ই বড় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এখন দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের পরেই একটি ব্র্যান্ডিং ফসল হয়ে উঠেছে ভুট্টা।
দেশে এখন বৃহৎ পরিসরে ভুট্টার চাষাবাদ ও বাণিজ্যিক কারবার শুরু হয়েছে। হাঁস-মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই এখন ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি বেসরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভুট্টার আটা, তেল ও ভুট্টাজাত পণ্য তৈরিতে বিনিয়োগ করছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছর ভুট্টার আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এসেছে মাত্র ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন। যেখানে তার আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৬৩ হাজার টন। এছাড়া তার আগের অর্থবছর ২১ লাখ ৬৮ হাজার টন এবং তার আগে ২০২০-২১ এ আমদানি হয়েছে ২৪ লাখ ৫৬ হাজার টন।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশে ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা ৬০ লাখ টনেরও বেশি। গত বছর দেশে ৫৬ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয়। যে কারণে আমদানিনির্ভরতা কমছে।
কম এসেছে পেঁয়াজ-আদা
দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় এ পণ্যটির সংকট তৈরি হয় প্রায় প্রতি বছর। গত অর্থবছর পেঁয়াজ আমদানি হয় ৫ লাখ ৯৭ হাজার টন, যা তার আগের অর্থবছর (২০২২-২৩) ছিল ৭ লাখ ৪৩ হাজার টন। তার আগে ২০২১-২২ এ ৬ লাখ ৬৪ হাজার টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়।
ঢাকার শ্যামবাজারের একজন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক আবদুল মাজেদ বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। গত মে মাসে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানিমূল্য (এমইপি) টনপ্রতি ৫৫০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। যে কারণে ওই সময়ের পর থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে।’
পেঁয়াজ ছাড়াও কম এসেছে আদা। তবে কিছুটা বেড়েছে রসুনের আমদানি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৬শ টন রসুন এসেছে দেশে। ২০২২-২৩ এ ৯৪ হাজার ৯ টন, ২০২১-২২ এ ৫০ হাজার ৪৫৩ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৫৭৮ টন রসুন আমদানি হয়েছে।
এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৯ হাজার ৬৮৪ টন, ২০২২-২৩ এ ১ লাখ ৪১ হাজার টন, ২০২১-২২ এ ১ লাখ ৬৬ হাজার টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রপ্তানির দেশ, আমদানিকারকে পরিণত হওয়া খুব দুঃখজনক। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানি তো দূরের কথা, আমদানি করেও বাজার সামাল দিতে পারছে না সরকার। আসলে এখন কিছু পণ্য উদ্বৃত্ত নেই। সে সুযোগে আবার ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সুবিধা নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু পণ্যের আমদানি আবার কমেছে, সেটা ভালো। এতে সংকটের সময় ডলার সাশ্রয় হয়েছে। তবে সেসব পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতাদের ভুগতে হয়েছে। যে কারণে ওইসব পণ্যের উৎপাদন আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’ জাগো নিউজ।