ডা. মো. শাহনেওয়াজ চৌধুরী: ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যদিও এই রোগের প্রকৃতি অনেক ব্যাপৃত ও জটিল তথাপি সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে চিকিৎসা তুলনামূলক ভাবে সহজ, সুলভ এবং অত্যন্ত কার্যকরী।
উদ্দেশ্য
- জনমনে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে দ্রুত শনাক্ত করে রোগের চিকিৎসা শুরু করা এবং এই রোগের মৃত্যুর হার কমানো।
- একইসঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমন্বিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবলম্বন করে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো।
রোগতত্ত্ব ও পরিসংখ্যান
- ১৯৭০ সালের পূর্বে বিশ্বজুড়ে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে শতাধিক দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রভাব দেখা যায়।
- গত ১০-১৫ বছর যাবৎ ডেঙ্গুর প্রভাব এবং হেমোরেজিক জ্বরের জন্য বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং মৃত্যুবরণ করে।
বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত
- আমাদের দেশে প্রথম মহামারী হয়েছে ২০০০ সালে। সে বছর ডেঙ্গু রোগে ৯৩ জন মানুষ মারা যায়। ২০০২ সালে মারা যায় ৫৮ জন।
- ২০১৮ সালে সর্বমোট ১০ হাজার মানুষের বেশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং ২৬ জন মৃত্যুবরণ করে।
- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫১ হাজার ৮৩২ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ২৫১ জন। (সরকারি এ হিসাবের বাইরে আরও বিপুল সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু রয়েছে)।
ডেঙ্গু রোগের কারণ
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগের জীবাণুর নাম ডেঙ্গু ভাইরাস। এই ভাইরাসের চারটি প্রজাতি আছে। চার প্রকার ভাইরাসের কারণে একজন মানুষের একাধিকবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে। দ্বিতীয় বার আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে পারে।
প্রজাতিগুলো হলো-
- ডেঙ্গু এক।
- ডেঙ্গু দুই।
- ডেঙ্গু তিন।
- ডেঙ্গু চার।
ডেঙ্গু রোগের ধারক ও বাহক
ডেঙ্গু রোগের বাহক হচ্ছে স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা। জানা মতে, এ রোগের একমাত্র ধারক হচ্ছে মানুষ।
স্ত্রী জাতীয় এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। সাধারণত দিনের বেলায় এ মশা কামড়ায়।
এডিস মশার বিস্তার
এরা গাছের গর্তে, প্লাস্টিকের পাত্রে, বাঁশের কাণ্ডে, ডাবের খোসা ও জমে থাকা পানিতে সবচেয়ে বেশি ডিম পারে। এদের ডিম শুকনো জায়গায় এক বছরের বেশি থাকে এবং পানির সংস্পর্শে আসলে এরা দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বিস্তার নির্ভর করে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার উপর। সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং ৮০ শতাংশ আর্দ্রতায় ডেঙ্গুর জীবাণু বেশি বিস্তার লাভ করে।
ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ
নারী এডিস মশা আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে এ রোগ ছড়ায়। ডেঙ্গু রোগের জীবাণু আক্রান্ত নারী মশার শরীরে ১০-১৫ দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তা পরবর্তীতে কামড়ের মাধ্যমে অন্য মানুষকে আক্রান্ত করে।
সংক্রমণকাল
আমাদের দেশে সাধারণত বর্ষাকাল ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে এ রকম পরিবেশ বিরাজ করে। জুন/জুলাই থেকে অগাস্ট/সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। কখনো কখনো এটা নভেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে।
উপসর্গ ও লক্ষণ
- উচ্চ তাপমাত্রা।
- মাথা ব্যথা।
- জোড়ায় গিটে মাংস পেশিতে ব্যথা।
- শরীরে লালচে হামের মত দানার দাগ/গোটা/ফুসকুড়ি।
- বমি।
- পাতলা পায়খানা।
- লিভার বড় হয়ে যাওয়া।
- রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় সমস্যা।
ডেঙ্গু রোগের প্রকার
- সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর।
- সতর্ক চিহ্নসহ ডেঙ্গু জ্বর।
- মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর।
ডেঙ্গু রোগের পর্যায়
- ডেঙ্গু জ্বর।
- ক্রিটিকাল বা সংকটপূর্ণ অবস্থা (জ্বর শুরু হওয়ার ৩-৪ দিন পরে শুরু হয়)।
- পুনরুদ্ধার বা কনভালসেন্স (জ্বর শুরু হওয়ার ৬-৭ দিন পরে শুরু হয়)।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ
- শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৫ এ উন্নীত হওয়া।
- মাথা ব্যথা, মাংস পেশি ও চোখের পেছনে ব্যাথা, পেটে ব্যথা এবং হাড়ে বিশেষ করে মেরুদণ্ডে ব্যথা।
- অরুচি ও বমি বমি ভাব ও বমি করা।
- চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ, চোখে রক্ত জমাট বাধা।
- লালচে/কালো রঙের পায়খানা, দাঁতের মাড়ি, নাক, মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হওয়া।
- শরীরে হামের মতো দানা দেখা দিতে পারে।
সচরাচর টানা ৫-৬ দিন জ্বর থাকে। কিন্তু এবার অপেক্ষাকৃত কম সময় ধরে জ্বর থাকার পরই হঠাৎ মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরে (ক্রিটিক্যাল ফেইজ) এ মোড় নিচ্ছে।
মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর
- শরীরের অভ্যন্তরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া।
- পেটে ও ফুসফুসে পানি জমা।
- রক্তচাপ কমে যাওয়া, নাড়ীর গতি দ্রুত হওয়া, ছটফট করা, শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া ও অজ্ঞান হয়ে পড়া।
বিশেষ সতর্কতা
জ্বর থেকে সেরে ওঠার সময় সতর্ক থাকবেন কারণ এ সময়ই জটিলতাগুলো দেখা যায়। তাই জ্বর কমলেই কাজে যোগ দেবেন না। কয়েকদিন অবশ্যই বিশ্রাম নেওয়া উত্তম।
সতর্ক চিহ্ন
- জ্বর কমার পরও রোগীর শারীরিক উন্নতি না হওয়া।
- ঘন ঘন বমি হওয়া।
- তীব্র পেট ব্যথা।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি অথবা অস্থিরতা।
- অস্বাভাবিক আচরণ।
- রক্তপাত ও কালো পায়খানা।
- হাত পা হিম হয়ে আসা।
- প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া।
- পেট ও ফুসফুসে পানি জমা।
- লিভার বড় হওয়া।
রোগ নির্ণয়
দ্রুত রোগ নির্ণয় ডেঙ্গু রোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কিছু কিছু রোগী খুবই অল্প সময়ে অবস্থা খারাপ হয়ে মারা যেতে পারে। নিম্নে উল্লেখিত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে।
- CBC: ( TLC, Hct, Platelet Count).
- Dengue NS1 : ১ম দিন হতে ৪র্থ দিন পর্যন্ত।
- Dengue IgM : ৫ম দিনের পরে।
- ডেঙ্গু ভাইরাস আইসোলেশন।
- চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে রোগীর লিভারের পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ইত্যাদি করতে পারেন।
- অতিরিক্ত পরীক্ষা নিষ্প্রয়োজন।
চিকিৎসা
বাসায় চিকিৎসা
- আতঙ্কিত না হয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।
- পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার পান করতে হবে।
- জ্বর ও বমি হলে ওরাল রিহাইড্রেশন স্যালাইন পান।
- অন্যান্য যে সকল তরল খাবার দেয়া যেতে পারে: ডাবের পানি, দুধ, স্যুপ, শরবত, ফলের জুস, ডাল ইত্যাদি।
জ্বরের চিকিৎসা
- ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় সাধারণত প্যারাসিটামল ব্যবহার করা হয়।
- অন্যান্য জ্বরনাশক ঔষধ যেমন এসপিরিন, আইব্রুফেন, ক্লোফেনাক প্রভৃতি ঔষধ ব্যবহার করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
- এ সকল ঔষধ ব্যবহারে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরবর্তীতে তা মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরের রুপ নিতে পারে।
হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা
- মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত সকল রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
- জরুরী ভাবে রোগীকে শিরায় (আইভি) স্যালাইন দিতে হবে (২৮-৪৮ ঘন্টা)।
- প্রতি দুই ঘন্টা পর পর বা আরও ঘন ঘন নাড়ীর গতি, রক্ত চাপ পরীক্ষা করতে হবে।
- কোনো প্রকার রক্তপাত হচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে।
- ৬-১২ ঘন্টা পর পর রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।
রোগী শকে চলে গেলে করণীয়
- অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থাকে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলা হয়।
- জরুরি ভাবে আইসিইউতে স্থানান্তরিত করতে হবে।
- প্রটোকল অনুযায়ী শিরায় স্যালাইন দিয়ে শকের চিকিৎসা করতে হবে।
- প্রয়োজনে রক্ত সঞ্চালন করতে হবে।
প্লাটিলেট সঞ্চালন
- অধিকাংশ সময় রোগী ও তার স্বজনদের মধ্যে প্লাটিলেট সঞ্চালন নিয়ে ভীতি কাজ করে। কারণ সকল চিকিৎসা কেন্দ্রে প্লাটিলেট সঞ্চালনের ব্যবস্থা নেই।
- প্রকৃতপক্ষে খুব কম সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট সঞ্চালন প্রয়োজন হয়।
- ডেঙ্গু হলেই প্লাটিলেট বা রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হবে অনেকেরই এই ভুল ধারণা রয়েছে।
অন্যান্য চিকিৎসা
- অক্সিজেন দেয়া।
- এন্টি আলসার মেডিসিন।
- রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বজায় রাখা।
- রক্তের লবণের মাত্রা বজায় রাখা।
- রক্তের এসিড ক্ষারের মাত্রা বজায় রাখা।
আরোগ্য লাভের লক্ষণ
- নাড়ীর গতি, শ্বাসের গতি, রক্তচাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা।
- শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হওয়া।
- রক্তপাত বন্ধ হওয়া।
- খাবারের রুচি স্বাভাবিক হওয়া।
- বমি/পেট ব্যথা ভালো হওয়া।
- প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক হওয়া।
- রক্তের সকল উপাদান স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা
- গায়ের দাগগুলো ম্লান হয়ে আসা।
ডেঙ্গু রোগের প্রতিরোধ
জমা পানি যেখানে ডেঙ্গু বাহক মশার জন্ম সেখানে। বাড়ির আশপাশে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিরোধ
- এ সময়ে ফুল হাতা জামা ও প্যান্ট পরিধান করা।
- ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা (দিনে ও রাতে)।
- মশার কয়েল/এরোসল ব্যবহার করা।
- রিপিলেন্ট ওয়েল ব্যবহার করা।
- বাড়ির ভেতর ফুলের টব এবং বাড়ির আশপাশে পানি জমতে না দেয়া।
- দরজা জানালায় মশা প্রতিরোধক জাল লাগানো।
- ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, ভাঙ্গা হাড়ি-পাতিল, টিনের কৌটা, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, ভাঙ্গা কলস, ড্রাম, নারিকেল এবং ডাবের খোসা, কন্টেইনার, এয়ার কন্ডিশনার রেফ্রিজারেটরের তলায় পানি জমতে না দেওয়া।
সমন্বিত ভাবে বাহক নিয়ন্ত্রণ
- এডিস মশার নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলো লার্ভার উৎপত্তি রোহিতকরণ। স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয়তাই পারে একে নিয়ন্ত্রণে আনতে।
- ব্যক্তিগত এবং জাতীয় পর্যায়ে এডিশ মশা নিয়ন্ত্রণে সুপরিকল্পিত ভাবে একনিষ্ঠ হতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রতিরোধ
- হাসপাতালের ভর্তি জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারি ব্যবহার করতে হবে।
- মশার লার্ভার জন্মস্থান ঘন ঘন পরিষ্কার করতে হবে।
- হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে নিয়মিত ফগিং করতে হবে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট রোগীর প্রতিবেদন পাঠাতে হবে।
সামাজিক পর্যায়ে প্রতিরোধ
- মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা।
- মশা নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
- মশা নিধনে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচার চালানো যেমন, রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার, মাইকিং, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি।
আমাদের সকলকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে ডেঙ্গু রোগ মহামারীকালীন পরিস্থিতিতে ইদানিং উপসর্গের ধরণ পাল্টে আমাদের আক্রান্ত করছে। সর্বশেষ বলতে চাই, সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। আসুন সবাই সুস্থ থাকার জন্য সতর্ক থাকি।
ডা. মো. শাহনেওয়াজ চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।