গোলাম রহমান: সংবিধান অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ২৯টি দল নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। একটি ক্ষুদ্র দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে কমিশন তাদের সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে। অন্য একটি দল তাদের সব প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
অন্যদিকে, রাজপথের বিরোধী শক্তি বিএনপি ও অবশিষ্ট নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বর্জন করছে। তারা মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের দাবি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান, যার সুযোগ সংবিধানে নেই। এবারের নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনে মোট দুই হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন।
এর মধ্যে নির্বাচন কর্মকর্তা পর্যায়ে এক হাজার ৯৮৫ জনের প্রার্থিতা বৈধ এবং ৭৩১ জনের প্রার্থিতা অবৈধ বিবেচিত হয়। এর বিপরীতে নির্বাচন কমিশনে ৫৬০টি আপিল আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৫২৫টি আবেদন ছিল প্রার্থিতা ফেরত পেতে এবং ৩৫টি বৈধ ঘোষিত প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে। আপিলে কমিশন ২৮০ জনের প্রার্থিতা বৈধ হিসেবে রায় দেয় এবং বৈধ ঘোষিত পাঁচ জনের প্রার্থিতা বাতিল করে।
সব মিলিয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে এবারের নির্বাচনে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ২৬০। তাদের মধ্যে ৩৪৭ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। উচ্চ আদালতে আপিল করে কমিশন কর্তৃক বাতিলকৃত কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন। ফলে ২০২৪-এর নির্বাচনে সর্বমোট ২৭টি রাজনৈতিক দল এবং এক হাজার ৯১৩ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন।
জাতীয় পার্টি থেকেও প্রায় সমান সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত দলটির অনেক সদস্যও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বিএনপি ও তার নির্বাচন এবং পরবর্তী সম্ভাব্য সমীকরণ সমমনা অন্যান্য দলের স্বল্পসংখ্যক সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা ৪৩৬। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল অবশিষ্ট প্রার্থীর মনোনয়ন দিয়েছে। প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় ২০২৪ সালের নির্বাচন ১৯৯১-পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে অধিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে বলে আশা করা যায়।
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। কয়েকজন আইনজীবী এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট ২০০৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। রিট আবেদনকারী আইনজীবী এম সলিম উল্লাহ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১১ সালের মে মাসে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনা করে অবৈধ ঘোষণা করেন। আপিল বিভাগের রায়ের পর জুন মাসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তনের লক্ষ্যে তখন থেকেই আন্দোলন করে আসছে। বিএনপি ও তার সমমনা কয়েকটি দলের বিশ্বাস, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা সম্মিলিতভাবে ৭ জানুয়ারী ২০২৪-এর নির্বাচন বর্জন এবং সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা আবারও প্রবর্তনের লক্ষ্যে আন্দোলন করছে। তারা জনগণকে এই নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান করছে।
২০১৪ সালে নির্বাচনবিরোধীদের আন্দোলন নির্বাচনের আগে এবং পরবর্তী সময়ে সহিংস রূপ গ্রহণ করে। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্বচ্ছতার সঙ্গে উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরেপক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি ও নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি দলের সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে এক ধরনের সবুজ সংকেত দিয়েছে। এতে ভোটের মাঠে প্রতিযোগিতা বেড়েছে এবং ভোটার উপস্থিতিও বাড়তে পারে। অন্যদিকে নির্বাচনে কারচুপি রোধে নির্বাচন কমিশন পূর্ববর্তী যেকোনো সময়ের তুলনায় শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারও সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে আসছে। তা সত্ত্বেও ভোটের দিন ও পরবর্তী সময়ে হিংসাত্মক ঘটনার আশঙ্কা থাকছেই, যা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন্দ্রিক দ্বিদলীয় রাজনৈতিক আবর্তের সূচনা হয়। ওই নির্বাচনে মোট গৃহীত ভোট ছিল ৫৫.৪ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কাছাকাছি বা অধিক হলে নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক বিবেচনা করা অযৌক্তিক হবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় অনেকটাই সুনিশ্চিত বলা যায়। এই নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একই দলের স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেওয়া সদস্য। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে মনে হয়, আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে ১৮০ থেকে ২০০ আসনে জয়ী হতে পারে; আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আরো ৬০ থেকে ৭০টিতে এবং অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থী আরো ১০ থেকে ১৫টি আসনে জয়লাভ করতে পারেন। জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলের সর্বমোট ৩০ থেকে ৪০টি আসনে জয়লাভের সম্ভাবনা আছে। ধারণাপ্রসূত এই হিসাব যদি ভোট শেষে কাছাকাছিও হয়, তবে আগামী সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। প্রসঙ্গত, স্বতন্ত্র হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের সংসদে সরকারি দলে অন্তর্ভুক্তি সুবিবেচনাপ্রসূত ও নৈতিক হবে বলে মনে হয় না। স্বতন্ত্র গ্রুপের সদস্য হিসেবে তাঁরা সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তুলতে অবদান রাখলে জাতি উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়। কালক্রমে একটি বিকল্প বা তৃণমূল আওয়ামী লীগের সূচনাও এ থেকে হতে পারে।
বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করায় সচেষ্ট হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে স্বল্পবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমানে এরই মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিরোধীদের আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানা, সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উন্নয়নের সুফলের সুষম বণ্টন, সমাজে আয়বৈষম্য হ্রাস, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা জনবান্ধব পদক্ষেপের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এসব অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হলে, একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর বিরোধীদের সরকার পতনের চেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অন্যদিকে, সংসদের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র গ্রুপ কালক্রমে বিকল্প বা তৃণমূল আওয়ামী লীগ পৃথক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সংগঠিত হলে বিএনপির রাজনৈতিক প্রভাব ক্রমহ্রাসমান হয়ে পড়বে। সময়ই বলে দেবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ পরিবর্তনে সূদুরপ্রসারী কী ভূমিকা রাখবে।
লেখক : সভাপতি, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।