আব্দুল বায়েস: আধুনিক অর্থনীতির পিতা, বিশেষত মুক্তবাণিজ্য ও বাজারের প্রবক্তা এবং প্রচারক বলে খ্যাত অ্যাডাম স্মিথের প্রণিধানযোগ্য একটা মন্তব্য দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করা যেতে পারে। তিনি ইউরোপে রাজতন্ত্র আর বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যকার ‘অজাচারি বিবাহের’ নিন্দা করতেন।
একটা বিখ্যাত বিবৃতিতে স্মিথ সাবধান করে বলেছেন, ‘ভোক্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ছাড়া ব্যবসায়ীরা খুব কমই একত্র হয়। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন স্থানীয় বাণিজ্য চেম্বারের সভায় যিনি মুক্তবাজারের উচ্চ প্রশংসা করলেন, তিনিই একচেটিয়া ব্যবসা কিংবা বিশেষ সরকারি চুক্তি অথবা তার মুনাফা নিশ্চিত করে এমন লোভনীয় সুযোগ হাতে পেলে এক লাফে লুফে নিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না।
প্রসঙ্গত, বলে নেওয়া দরকার, অ্যাডাম স্মিথ, কার্ল মার্ক্স এবং থরস্টেন ভেব্লেনের মধ্যে মিল ছিল এই যে তাঁরা অনুভব করেছিলেন ব্যবসায়ীরা রাজনীতি পছন্দ করে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য।
দুই.
জাতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেশির ভাগ নাকি ব্যবসায়ী—কেউ ব্যবসা চালানোর পাশাপাশি রাজনীতি করেন, কেউ আবার রাজনীতি চালিয়ে ব্যবসায়ী বনেন। এ দেশে ব্যবসায় সম্পৃক্ততা নেই এমন নিখাদ রাজনীতিবিদ ভালো মানুষের মতোই বিরল প্রজাতি।
আপাতত থাক সে কথা।
সেই অ্যাডাম স্মিথই আবার একদা বলেছিলেন, মানুষ একটা উদ্বিগ্ন জীব (ম্যান ইজ অ্যান অ্যাংশাস এনিম্যাল)। তবে আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বিশেষ ক্ষেত্র উল্লেখ করে সম্ভবত বলা চলে যে এখানে উদ্বিগ্ন স্বল্প আয়ের, দরিদ্র মানুষ যখন তাদের আয় নিম্নমুখী কিন্তু বাজার থেকে যে পণ্য ও সেবা তারা ক্রয় করে থাকেন সেগুলোর দাম ঊর্ধ্বমুখী। আমজনতার এমনকি মিডিয়ার অভিযোগের আঙুল ব্যবসায়ীদের দিকে—অতি মুনাফার লোভ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ব্যবসাবান্ধব’ নয়, অথচ ‘ব্যবসায়ীবান্ধব’ নীতি এবং বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থার চরম ব্যর্থতা এই জ্বালায় জ্বালানি জোগায় বলে ধারণা করা যায়।
তিন.
বাংলাদেশে এখন ‘ব্যবসায়ীবান্ধব’ নীতি অধিকতর প্রভাবশালী বলে ধারণা করা হয়; যেখানে ভর্তুকি আর বিভিন্ন ধরনের সহায়তায় একটা তথাকথিত ‘উদ্যোক্তা শ্রেণি’ তৈরি করা হয়েছে। যেমন- তৈরি পোশাক শিল্প। জন্মের পর থেকে, তা চার দশক তো হবেই, মালিকরা সরকার থেকে পাওয়া ভর্তুকি পকেটে ভরছে, তাদের একটা অংশ আন্ডার আর ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি, অর্থপাচারের অভিযোগ নিয়ে এখন আসামির কাঠগড়ায়। বস্তুত বাংলাদেশের এমন বিত্তশালী খুব কম পাওয়া যাবে, যাঁর অন্তত একটা পোশাক তৈরির কারখানা নেই। তাঁরা তবু বিদেশে রপ্তানি করে ডলার আনেন- এমন যুক্তি অব্যাহত ভর্তুকির পক্ষে যথেষ্ট নয়।
শিশুটি কি কখনো বড় হবে না, ৪০ বছর পরও? অন্যান্য খাতে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও দেদার সুবিধা নিচ্ছেন সরকারি কোষাগার থেকে। এটা সেই দেশ যেখানে এক লাখ টাকার কম যখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা অত্যন্ত জরুরিঋণ সময়মতো না দেওয়ার দোষে কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দেওয়া হয়, ওয়ারেন্ট বেরোয়, কিন্তু শত শত কোটি টাকার ব্যাংকঋণ খেলাপিরা সদম্ভে ঘুরে বেড়ায় রাজনীতি ও সমাজের করিডরে- কেউ তাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারে না। অথচ একটা কার্যকর ‘ব্যবসাবান্ধব নীতি’, যেখানে ব্যবসায়ীর ব্যবসা করার পরিবেশ ভালো, কর কাঠামো এবং অবকাঠামোগত সুবিধা অনেক, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর কিংবা সরকারি নিয়ন্ত্রণ কোনো বাধা নয়- মোটকথা একটা পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের আবহ তৈরি করার নাম হচ্ছে ‘ব্যবসাবান্ধব নীতি’, যা বস্তুত একটু আগে উল্লিখিত ‘ব্যবসায়ীবান্ধব’ নীতির বিপরীত। একটা দেশে ব্যবসাবান্ধব নীতি থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষ লাভবান হয় (পজিটিভ সাম গেম)। আর ব্যবসায়ীবান্ধব নীতিতে ব্যবসায়ীর পোয়াবারো, ভোক্তার ভোগান্তি (নেগেটিভ সাম গেম)।
চার.
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্নগামী রিজার্ভ এবং ডলারের তীব্র সংকট নিয়ে নিশ্চয় স্বস্তিতে নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইদানীং পড়ন্ত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। বেশি বেশি লোক বিদেশে যাওয়া সত্ত্বেও রেমিট্যান্সের নিম্নগামিতা উদ্বেগের উৎস। গভর্নরের অস্বস্তিতে থাকার মূল কারণ, মুখরা মূল্যস্ফীতিকে বশীকরণের কোনো উপায় তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তিনি আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের দাওয়াই দিয়ে সাহায্য করার জন্য। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদর যে পরামর্শ তাতে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটবে।
মূল্যস্ফীতি নামক বাজারের চলমান আগুন নেভাতে হলে একটা মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে, সামগ্রিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণকল্পে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া। বহু আগেই এই সুপারিশ করা হয়ে থাকলেও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সুদের হার বৃদ্ধিতে উসখুস লক্ষণীয়। সুদের হার বৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ তারা মনে করে সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে, প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এর বিপরীতে যুক্তি হতে পারে দুই রকম : এক. সুদের হার যখন ছয়নয় ছিল, তখন কি বিনিয়োগের বন্যায় বাংলাদেশ ভেসে গিয়েছিল? তখন কি লাখ লাখ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়নি? আসলে কম সুদের হার বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এবং বেশি হার বিনিয়োগ সংকোচনে একটা শক্তিশালী প্রভাব রাখলেও সুদের হারই বিনিয়োগের একমাত্র নিয়ামক নয়। এবং এখানেই আসে ‘ব্যবসাবান্ধব নীতির’ পারঙ্গমতা এবং প্রয়োজনীয়তা। দুই. ধরে নিলাম সুদের হার বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ কমে প্রবৃদ্ধির হার প্রান্তিক পড়ে গেল। ঠিক এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কি বিনিয়োগবিলাস, না উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভোক্তার গলার ফাঁস?
প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এবং এর অব্যাহত বৃদ্ধির কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেটা জুতসই যুক্তি নয়। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে ২০২২ সালের মার্চ-জুন সময়ে যুদ্ধ মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে কিন্তু জুলাই থেকে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ নিম্নমুখী। আসলে মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী বড় বড় ব্যাবসায়িক সিন্ডিকেট কর্তৃক বাজারের আগুনে ঘি ঢালা, অর্থনীতিতে বিভিন্ন উৎস অর্থের জোগান বৃদ্ধি এবং নিয়ন্ত্রিত সুদের হার পেয়ে সামগ্রিক চাহিদা চাঙ্গা হয়েছে। মোটকথা যেখানে ব্যথাটা পায়ে, সেখানে চোখের ওষুধ লাগানো পায়ের ব্যথাকে আরো প্রলম্বিত করছে। সুতরাং সংকোচনমূলক পদক্ষেপের পথ ধরে সুদের হার বাড়ানো টাকা ছাপিয়ে ঋণ না দেওয়াই হবে উত্তম দাওয়াই।
এই পদক্ষেপ খুব বেশিদিনের জন্য নয় কিন্তু। মূল্যস্ফীতির স্তর ৫-৬ শতাংশ (যা প্রবৃদ্ধি সহায়ক) নেমে আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহে ঋণপ্রবাহের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তারপর আবার সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়া দরকার। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এত উঁচু মূল্যস্ফীতির জন্য সৃষ্ট জনদুর্ভোগ এবং জন-অসন্তোষ আসছে জাতীয় নির্বাচনে বড় দাগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌজন্যে, কালের কণ্ঠ।