ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: প্রাথমিকস্তরের প্রথম শ্রেণি ও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু করা হবে ২০২৩ সালে। এটি বাস্তবায়নে প্রতি ক্লাসে পাইলটিং করার কথা ছিল। বাস্তবে সেটা করা হচ্ছে শুধু ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় অন্য স্তরে পাইলটিং ছাড়াই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা। দেশের প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন থাকলেও অধিকাংশই সরকারের অননুমোদিত হওয়ায় এর শিক্ষকরা থাকবেন প্রশিক্ষণবঞ্চিত। আর পাইলটিং তো হচ্ছেই না। যার প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে প্রাথমিকস্তরের প্রথম শ্রেণি ও মাধ্যমিকে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়নের ফলে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকবে না কোন বিভাগ বিভাজন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাইকে পড়তে হবে ১০টি বিষয়। দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপরই অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভাগ পছন্দ করতে হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে নেওয়া হবে পরীক্ষা। এ দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসির ফল।
এছাড়া, প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকছে না। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে আটটি বই। তবে সব শ্রেণিতেই শিখনকালীন মূল্যায়নেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পদ্ধতিতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা থাকছে না। চলতি বছর মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিং শুরু হয়েছে।
২০২৩ সালে প্রথম এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণি।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আংশিক হলেও পাইলটিংয়ের আওতায় এসেছে। শিক্ষকরাও পাবেন নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ। সবচেয়ে বিপাকে আছে দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব স্কুলে পাঠদান করা শিক্ষকদের বড় একটি অংশ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তাদের দিয়েই পড়ানো হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। পার্শ্ববর্তী অনুমোদিত কোন স্কুল-কলেজ থেকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। অনুমোদন না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ কম।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. আব্দুল অদুদ বলেন, নতুন কারিকুলাম পড়াতে কিন্ডারগার্টেনে সে ধরনের পরিবেশ ও অবকাঠামো নেই। এতে নতুন বৈষম্য তৈরি হবে। কিন্ডারগার্টেনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। কোথাও কোথাও আবার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তও পড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশে কতগুলো এ ধরনের স্কুল রয়েছে, সেখানে কতজন শিক্ষক আছেন, শিক্ষকদের কতটুকু যোগ্যতা আছে সে হিসাব সরকারের কাছে নেই।
দেশে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে শর্ত শিথিল করে দেশের সব কিন্ডারগার্টেন স্কুল সরকারের অওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন কারিকুলামের বই সব অনুমোদিত-অননুমোদিত স্কুল-কলেজে দেওয়া হবে। সঙ্গে ক্লাসে পড়ানোর জন্য পাবেন শিক্ষক নির্দেশিকা। যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে তাই তাদের ক্ষতি যেন না হয় সেটি চিন্তা করে বিনামূল্যের পাঠ্যবই দেওয়া হবে। সেজন্য চাহিদাও সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবই পড়াতে গেলে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। যেসব স্কুল-কলেজের অনুমতি রয়েছে সেখানকার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দু-একজন করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা নিবন্ধিত নয়, স্কুলের অনুমতি নেই তাদের তো প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। আনাচে-কানাচে কীভাবে এসব প্রতিষ্ঠান চলছে?
প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, অনুমতি না থাকলে যেখানে যোগ্য শিক্ষক নেই, সেখানে প্রশিক্ষণের চিন্তা করা যায় না। এসব নামসর্বস্ব স্কুলে যারা পড়বে তারা পিছিয়ে যাবে। তাই সেখানে যাতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভর্তি না করান।
তবে বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছোট পরিসরে গড়ে তোলা হয় বলে এখানে বেশি বেতন দিয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। সে কারণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে পাঠদান করানো হয়।
তিনি বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিবন্ধন করার কথা থাকলেও নিজস্ব জমি, বড় পরিসরে বাসা, অর্থ জামানতসহ বেশ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেওয়ায় এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক স্কুল নিবন্ধনের আওতায় এসেছে। অনেকে আবেদন করেছে। তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এসব বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন কারিকুলামের বই পাবে। তার সঙ্গে শিক্ষক নির্দেশিকা দেওয়া হবে। সেটি অনুসরণ করে শিখন, শেখানোর কাজটি করতে হবে।
কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হবে না। নতুন কারিকুলামের মাধ্যমে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। যারা পড়াতে পারবেন না তারা ঝরে যাবেন। সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অনুমোদন ছাড়া পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। স্কুলের আশপাশের মানুষ বুঝে না বুঝে সেখানে তাদের সন্তানকে ভর্তি করাচ্ছেন। এসব স্কুলে নেই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, নেই অবকাঠামো, তার মধ্যে চলছে পড়ালেখা।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা স্কুল-কলেজ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও কলেজ) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, অনুমোদিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নতুন কারিকুলামের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, অনুমোদন ছাড়া স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সেটি দীর্ঘদিন ধরে চললেও তা বন্ধ করা হচ্ছে না। সেখানে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন। যারা পড়ান তাদের মাধ্যমে সঠিকভাবে নতুন কারিকুলামের পাঠদান কঠিন হয়ে পড়বে। তাদের প্রশিক্ষণও সম্ভব নয়। এতে নতুন বৈষম্য তৈরি হবে। যেগুলোতে শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি আওতায় আনতে হবে। নতুবা নতুন শিখন ও শেখানের পদ্ধতি শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কেউ অনুধাবন করতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন নিয়ে আমাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। এদের ওপর সরকারের কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনে এ বিষয়টি সুনির্দিষ্ট থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। নতুন বই তাদের কাছে গেলে কীভাবে জেনে-বুঝে শিখন ও শেখানোর পদ্ধতি অনুসরণ করবেন সেটি বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাউশির তত্ত্বাবধানের যে পদ্ধতিতে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে একইভাবে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাউশির জুম প্রশিক্ষণ উন্মুক্ত করে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের যুক্ত করা যেতে পারে। অথবা একটি অ্যাপস তৈরি করে সেখানে প্রশিক্ষণের ক্লাসগুলো যুক্ত করতে হবে। নতুন কারিকুলামে শিখন-শেখানের বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হবে। এতে তৈরি হবে নতুন বৈষম্য। জাগো নিউজ।