অন্যান্য ডেস্ক: পৃথিবীর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললে আমাদের মনে আসে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের কথা। আধুনিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায়, তার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। এরা কিন্তু প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় নয়। বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এখনও মরক্কোর বুকে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে এখনও পড়াশুনো থেকে ডিগ্রি প্রদান সবই হয়।
৮৫৯ সাল, অর্থাৎ আজ থেকে ১১০০ বছরেরও বেশি আগের ঘটনা। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১০০তম বর্ষপূর্তি হয়। মরক্কোর ফেজ শহরের বুকে তৈরি হলো ইউনিভার্সিটি অফ আল-কারাউইন। এটিই ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের প্রাচীনতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এখানে ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। পড়ানো হতো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বিষয়। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় যিনি তৈরি করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন পুণ্যবতী মুসলিম নারী, নাম ফতিমা আল-ফিহরি।
খ্রিস্টীয় নবম শতকে বর্তমান তিউনিসিয়ার কারাওইন শহরে ৮০০ সালে জন্মেছিলেন ফতিমা। তারপর শৈশবেই পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন মরক্কোর ফেজ শহরে। আল-ফিহরি পরিবার ফেজে আসেন নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে। সেখানে প্রাথমিক কিছু জটিলতা কাটিয়ে ফতিমার পিতা বিন আবদুল্লাহ ব্যবসা ক্ষেত্রে বেশ সফল হয়ে ওঠেন। তার বাবা মুহাম্মদ আল-ফিহরি ছিলেন, ফেজ নগরীর একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। প্রচুর সম্পত্তির মালিক হন তিনি। পিতার মৃত্যুর পর ফতিমা ও তার বোন মারিয়াম সেই বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। মরক্কোর মুসলিম জনগোষ্ঠী তখন ধীরে ধীরে উন্নতি করছে।
ফাতিমা তার অংশের সব অর্থ খরচ করেন লেখকদের জন্য সুবিধাসম্পন্ন একটি মসজিদ তৈরির কাজে। ৮৫৯ সালে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।ফতিমা তাঁর বিপুল সম্পত্তি মসজিদের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করতে থাকেন। কেবল ইবাদতের স্থান না হয়ে এই মসজিদ শিগগিরই হয়ে ওঠে ধর্মীয় নির্দেশনা ও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্র। ইতালির বোলোনায় যখন প্রথম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তারও আগে কারাওইন হয়ে ওঠে বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তার পাশাপাশি তাঁর মনে হতো, মানুষের উন্নতির জন্য সর্বপ্রথম দরকার শিক্ষা। সেই সূত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়।
শুরুতে এটি ছিল ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। পরে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে পারিপার্শ্বিক বিষয়য়াদি পড়ানো হয়। অল্প সময়ে এর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে। তারা সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে ইতিহাস-ভূগোলসহ অনেক বিষয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করতে থাকেন। ফেজকে তখন বলা হতো, ‘পাশ্চাত্যের বাগদাদ’—‘বাগদাদ অব দ্য ওয়েস্ট’। ১৯১২-৫৬ সময়ে মরক্কো ফ্রান্সের অধীনে ছিল। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। ইউরোপের ষড়যন্ত্রের শিকার হয় ঐতিহ্যবাহী এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ওই সময় সেখানে পরীক্ষা ও ডিগ্রি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যযুগে মুসলমান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক জ্ঞান বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুবিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অগ্রণায়ন পণ্ডিত ইবনে মাইমুন, আল-ইদ্রিসি, ইবনে আরাবি, ইবনে খালদুন, ইবনে খতিব, আল-বিতরুজি (অ্যালপে ট্রেজিয়াম), ইবনে হিরজিহিম ও আল ওয়্যাজ্জেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন। অনেক অমুসলিমও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অমুসলিম অ্যালামনি ছিলেন- ইহুদি দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ মুসা বিন মাইমুন বা মাইমোনাইডস।
আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য দলিল-দস্তাবেজও বলে, বিশাল ও অসামান্য এ কীর্তি-অবদান মুসলমানদের। গিনেজ বুকের রেকর্ড অনুসারে, মরক্কোর ফেজ নগরীর কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।