ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: লাগামহীনভাবে চলছে রাজধানীর বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজগুলোতে শিক্ষা বাণিজ্য। বই-খাতার পাশাপাশি দেদারসে চলছে স্কুল ড্রেসের ব্যবসাও। স্কুল ভেদে রয়েছে এগুলোর দামেরও পার্থক্য। বাদ নেই স্বনামধন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল বা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। তবে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের রয়েছে নানা বাহানা।
রোববার (২৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়সহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের মধ্যেই রয়েছে বই-খাতা এবং ড্রেস তৈরির দোকান। দোকানের দায়িত্বে থাকা আইয়ুব আলী বলেন, ১ম শ্রেণীর ছাত্রীর জন্য ড্রেস (ফোরাক) বাবদ ১১০০ টাকা, (সাদা কেচ) জুতার জন্য ৭৫০ এবং সোয়েটারের জন্য ৬৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য খরচ (বেল্ট-ব্যাচ) সহ মোট খরচ হচ্ছে ২৮০০ টাকা। একজন শিক্ষার্থীকে ২ সেট করে পোশাক নিতে হচ্ছে। তবে ছেলেদের পোশাকের দাম কিছুটা বেশি।
একইভাবে ৩য় শ্রেণীর ছাত্রীদের ড্রেসের জন্য ১২০০ টাকা, (সাদা) জুতার জন্য ৮০০ টাকা এবং সোয়েটার বাবদ নেওয়া হচ্ছে ৭৫০ টাকা। এছাড়াও অন্যান্য খরচ মিলে দাম পড়ছে ৩ হাজার টাকা। এই হিসেবে যে যত উপরের ক্লাসে পড়ছে, তার পোশাকের দাম ততোটা বেশি পড়ছে।
এছাড়াও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের মধ্যেই রয়েছে বই-খাতা এবং ড্রেসের দোকান। সেখানে দামটা আরও কিছুটা বেশি।
সেখানে ১ম শ্রেনীর ছাত্রের ড্রেস (প্যান্ট-শার্ট) বাবদ ১২শ টাকা, সোয়েটার ৮০০ টাকা, জুতার জন্য (গায়ের মূল্য অনুযায়ী) ১২০০ টাকা এবং মোজার জন্য ১০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর ৫ম শ্রেণীর ছাত্রের ড্রেসের জন্য ১৪০০ টাকা, সোয়েটার ৮৫০, জুতা ১৪০০ টাকা এবং মোজার জন্যও টাকা নেওয়া হচ্ছে।
তবে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের বই-খাতা নির্দিষ্ট একাধিক দোকান থেকে কেনার সুযোগ থাকলেও ড্রেস ক্যাম্পাসের মধ্যেই তৈরি করা হচ্ছে। দাম নেওয়া হচ্ছে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ এবং মডেল স্কুল এন্ড কলেজের মতোই।
দাম নির্ধারণের বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের গভর্ণিং বডির অভিবাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দীন বলেন, আমাদের কাজ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা। বই-খাতা বা ড্রেস তৈরির বিষয়ে যা করার প্রিন্সিপাল করেন, আপনি তার কাছ থেকে তথ্য নিতে পারেন। আর যতটুকু জানি- স্কুলের মধ্যে এখন ড্রেস তৈরি করা হয় না, আগে করা হতো।
তবে ড্রেস তৈরির দায়িত্বে থাকা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক নারী জানান, তারা স্কুলের বেতনভূক্ত কর্মচারী। ড্রেস তৈরির দোকানটি স্কুল থেকে পরিচালনা করা হয়। এর প্রতি উত্তরে নাসির উদ্দীন বলেন, তাহলে বিষয়টি আমার জানা নেই। জানা দরকার ছিল কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অভিবাবক প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমি ঢাকার বাইরে আছি।
এবিষয়ে স্কুলটিতে মেয়েকে ভর্তি করতে আসা আবুল হাসনাত (ডাকনাম) বলেন, অভিবাবক প্রতিনিধিদের কাজ অভিবাবকদের প্রতিনিধিত্ব করা। কিন্তু তারা নির্বাচিত হয়ে যদি সেটা না করে, তাহলে দুঃখজনক। এখানে ড্রেসের দাম বেশি বা কম নিলেও আমাদের কিছুই করার নেই। সেটা পারে- অভিবাবক প্রতিনিধিরা।
তবে ড্রেসের দাম কিছুটা কম রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলে। প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিবাবক রবিন জানান, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর ড্রেসের জন্য এখানে নেওয়া হচ্ছে ১০০০ টাকা এবং ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম পর্যন্ত ১৪০০ টাকা। আর জুতা বা সোয়েটার বাইরের থেকে কিনতে হয়। তবে তারপরও দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। কারণ তাদের প্রকৃত খরচ অনেক কম পড়ে।
এবিষয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকার ট্রেইলার এনামুল জানান, ১ম শ্রেণীর ছাত্রীদের স্কুল ড্রেসের (ফোরাক) জন্য ২ গজ থেকে ২ গজ ২ গিরা, আর ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রীদের জন্য ৩ গজ থেকে ৩ গজ ২ গিরা কাপড় লাগে। আমার কাছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা গজের কাপড় রয়েছে। আর আমরা বানানোর মজুরি নেই ৩০০ টাকা। অর্থাৎ সব মিলে (বেল্ট সহ) ১ম শ্রেণীর ফোরাকের জন্য খরচ পড়ে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। আর ৬ষ্ঠ শ্রেণীর জন্য পড়ে ৭০০ টাকার মতো। তবে ছেলেদের ড্রেসে খরচ একটু বেশি পড়ে।
তবে রবিন জানান, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল থেকে যে কাপড়ের ড্রেস দেওয়া হয়েছে, তার মূল্য ১০০ থেকে ১২০ টাকা গজের মধ্যে হবে। আর এমন ড্রেস ২৫০ টাকায় আমরা (নিকট আত্মীয়) তৈরি করি। যে ড্রেস ১ হাজার টাকা নিচ্ছে তার খরচ (ব্যাজ-বেল্ট সহ) ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা হবে। অর্থাৎ মাসিক বেতন বাদেও খাতা বা ড্রেস থেকে বাড়তি মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ বেলায়েত হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ভালো কাপড় দেওয়ার কারণে ড্রেসের দাম বেশি পড়ছে। তাছাড়া আমরা আশপাশের স্কুলের থেকে সব কিছুতেই কম দাম নিচ্ছি।
তথ্য মতে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে ১২ হাজার। এর মধ্যে প্রতি বছর ২ সিফটে শুধু প্রথম শ্রেণীতেই ভর্তি হয় ৭০০ শিক্ষার্থী। প্রথম শ্রেণীর ছাত্রীদের ড্রেসের জন্য নিচ্ছে ১১০০ টাকা। কিন্তু বানানোর খরচ পড়ছে সর্বচ্চ ৭০০ টাকা। ড্রেস প্রতি প্রায় ৪০০ টাকা লাভ করছে তারা। অর্থাৎ শুধু ১ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ড্রেস তৈরি থেকেই কয়েক লাখ টাকা তুলে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলটিতেও প্রায় একই রকম শিক্ষার্থী রয়েছে। সেই হিসেবে, শুধু ড্রেস থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করছে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো।
এবিষয়ে মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের একাধিক অভিবাবক হতাশার সাথে ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা এখন ব্যবসা হয়ে গেছে। ভালো স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা অনেকটা প্রফেশনাল ব্যবসায়ীর মতো ব্যবহার কারেন। স্কুলের লোগো করা খাতা ছাড়া ব্যবহার করতে দেয়না। স্কুল থেকেই পোশাক কিনতে হয়। যখন যে বিষয়ে টাকা চায় দিতে হয়। সম্মানের চিন্তা করে আমরা কোন বিষয়ে যাচাইও করতে পারি না।
এদিকে লাভের টাকা কি করা হয়- এমন প্রশ্নে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা কর্মচারিরা জানান, এ টাকা আশিকস (আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ শিক্ষক- কর্মচারি সমিতি) নেয়। একই কথা বলেন মীরহাজীরবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, মুনাফার টাকা স্কুলের শিক্ষক কল্যাণ সমিতিতে দেওয়া হয়।
তবে এ ব্যবসায় পিছিয়ে নেই কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলোও। রাজধানীর কিন্ডারগার্টেন গুলো বই-খাতা ছাড়াও ড্রেস বাণিজ্যে রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। সরকারি তদারকির অভাবে অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে থাকা এ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো অনেকটা দোকানের আদলে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ব্যবসা করছে।
উত্তর যাত্রাবাড়ীর উইংস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মহাখালীর মায়ের দোয়া কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাই স্কুল, গুলশানের চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুল, গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বাড্ডা সানশাইন মডেল স্কুল সহ অধিকাংশ স্কুলেই চলছে এ ড্রেস বাণিজ্য।
উইংস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একজন শিক্ষিকা জানান, ড্রেসের কাপর তারা নিজেরাই বিক্রি করেন, দাম ১৫০ টাকা গজ। আর সানশাইন মডেল স্কুল থেকে জানানো হয়, তাদের নিজস্ব ট্রেইলার রয়েছে।
সানশাইন স্কুলের ড্রেস বানানোর দায়িত্বে থাকা সামিয়া টেইলার্সের পরিচালক আবুবকর সিদ্দিক জানান, ড্রেসের কাপরের দাম ২০০ টাকা গজ। একটি ফোরাকে ২ থেকে আড়াই গজ কাপর লাগে। বানানোর খরচ মিলে ( ব্যাজ-বেল্টসহ) ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
তবে মায়ের দোয়া কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাই স্কুলের পরিচালক ও বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স এসোসিয়েশনের অর্থ সচিব মোঃ মাহমুদ হাসানের মতে, শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্যেই বই-খাতা বা পোশাক বানানোর দায়িত্ব নেওয়া হয়। আর বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের সহকারী শিক্ষা সম্পাদক মোঃ মোশাররফ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
এবিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রাক-প্রাথমিক) মহিউদ্দিন আহমেদ তালুকদার ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য করছে। তাদের অবৈধ এ শিক্ষা বাণিজ্যের বিষয়ে আমরা অবগত রয়েছে। অধিদপ্তর ওর্ডার দিয়েছে, খুব শীঘ্রই আমরা এ্যাকশানে যাবো।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপ-পরিচালক সেলিনা জামান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, সরকারী সিদ্ধান্তের বাইরে কারও চলার সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক স্কুলেই বাড়তি বই পড়ানো হচ্ছে বা বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রদক্ষেপ নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।
এদিকে দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গুলো মুনাফা লোভী হয়ে পড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সেই সাথে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্য বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা। তাদের মতে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান মুনাফা লোভী হয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।
এবিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, কিন্ডারগার্টেন এবং বেসরকারি স্কুল গুলোতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিষয়ে বেশি অনিয়মের অভিযোগ আসছে। তারা বই-খাতার পাশাপাশি স্কুল ড্রেসের বাণিজ্যও করছে। এ বিষয়ে আমরা এর আগেও অভিযান চালিয়েছি। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে এ বিষয়ে আমরা খুব দ্রুতই প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (২১ ডিসেম্বর) শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চারজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে ৪ টি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা সরকারি, বেসরকারি স্কুল এবং বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজে ২০২৩ শিক্ষা বর্ষে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি, ভর্তি ফি, উন্নয়ন ফিসহ অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে গ্রহণ করছে কিনা বা অন্য কোন মাধ্যমে টাকা নিচ্ছে কিনা – তা সরেজমিনে যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করছেন।