ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: লাগামহীন ভাবে চলছে রাজধানীর বেসরকারি স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিক্ষা বাণিজ্য। বেতন-ফি’র পাশাপাশি দেদারসে চলছে বই-খাতার ব্যবসাও। প্রতিষ্ঠান ভেদে রয়েছে এগুলোর দামেরও পার্থক্য। বাদ নেই সুনামধন্য মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল বা মডেল স্কুলের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। তবে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের রয়েছে নানা বাহানা।
গত রোববার থেকে মঙ্গলবার (২৫-২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মীরহাজীরবাগ উচ্চ বিদ্যালয়সহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের মধ্যেই রয়েছে বই-খাতা এবং পোশাক তৈরির দোকান। দোকান দুটি পরিচালনা করেন বাবা-ছেলে।
লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা ছেলে কামরুজ্জামান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য সাতটি বই পড়ানো হয়। সরকারি তিনটি বইয়ের বাইরে আরও চারটি সহায়ক বই কিনতে হয়। চারটি বইয়ের দাম ৬০০ টাকা৷ আর প্রতিটি বইয়ের জন্য দুটি করে আলাদা খাতা নিতে হয়। এক সেট খাতার দাম ৬০০ টাকা।’
একই ভাবে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের মধ্যেই রয়েছে বই-খাতা এবং পোশাকের দোকান। সেখানে প্রথম শ্রেণীর জন্য নেওয়া হচ্ছে ৪২০ এবং পঞ্চম শ্রেণীর জন্য ৭২০ টাকা।’
তবে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের পোশাকের জন্য একটি দোকান থাকলেও বই-খাতা নির্দিষ্ট একাধিক দোকান থেকে কেনার সুযোগ রয়েছে। স্কুলটির ৮ নং গেটের সামনের থিয়েটার কর্ণারে স্কুলটির লোগো যুক্ত প্রথম শ্রেণীর এক সেট খাতার দাম (১০ পিস) নেওয়া হচ্ছে ৩২০ টাকা, আর চতুর্থ শ্রেণীর জন্য ৭৬৫ টাকা। বাউন্ড সাইজের এ খাতা একটির জন্য দাম নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। তবে লোগো ছাড়া অন্য কোম্পানির একই খাতা ২০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানানো হয় দোকানটি থেকে। অর্থাৎ একই খাতায় বাড়তি নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা।
দাম নির্ধারণের বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের গভর্ণিং বডির অভিভাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দীন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাজ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা। বই-খাতা বা পোশাক তৈরির বিষয়ে যা করার প্রিন্সিপাল করেন।’
এ বিষয়ে স্কুলটিতে প্রথম শ্রেণীতে মেয়েকে ভর্তি করতে আসা আবুল হাসনাত (ডাকনাম) ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘অভিভাবক প্রতিনিধিদের কাজ অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্ব করা। কিন্তু তারা নির্বাচিত হয়ে যদি সেটা না করে, তাহলে দুঃখজনক। এখানে খাতার দাম বেশি নিলেও আমাদের কিছুই করার নেই। সেটা পারেন অভিভাবক প্রতিনিধিরা।’
একই অবস্থা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলেও। প্রতিষ্ঠানটির প্রাইমারী শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রবিন বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণীর এক সেট খাতার দাম নেওয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। এখানে যে খাতার দাম ৪০ টাকা নেওয়া হয়, বাইরে থেকে কিনলে (লোগো ছাড়া) দাম ৩০ টাকা পড়ে। অর্থাৎ বেতন-ফি’র বাইরেও তারা খাতা বিক্রি করেও আয় করছে।’
তবে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. বেলায়েত হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ভালো কাগজ দেওয়ার কারণে খাতার দাম বেশি পড়ছে।’
বাইরের খাতা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার জন্যেই শিক্ষার্থীদের স্কুলের লোগো যুক্ত খাতা ব্যবহার করতে বলা হয়।’
তথ্যমতে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে ১২ হাজার। এর মধ্যে শুধু প্রথম শ্রেণীতেই পড়ে ৭০০ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রতিটি খাতায় ১০ টাকা করে বাড়তি নিলে প্রথম শ্রেণী থেকেই ৭০ হাজার টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। এমন খাতা বছরে তিন থেকে চার বার কিনতে হয় শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও মতিঝিল আইডিয়াল বা অন্য স্কুলগুলোতেও প্রায় একই রকম শিক্ষার্থী রয়েছে। সেই হিসেবে, শুধু খাতা থেকেই প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সেই সঙ্গে সহায়ক বই বিক্রি করেও আয় করছে তারা।
এ বিষয়ে মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের একাধিক অভিভাবক হতাশার সঙ্গে বলেন, ‘শিক্ষা এখন ব্যবসা হয়ে গেছে। ভালো স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা অনেকটা ব্যবসায়ীর মতো ব্যবহার করে। স্কুলের বই-খাতা ছাড়া ব্যবহার করতে দেয় না। স্কুল থেকেই পোশাক কিনতে হয়। যখন যে বিষয়ে টাকা চায় দিতে হয়। আমরা কোন বিষয়ে যাচাইও করতে পারি না।’
এদিকে, লাভের টাকা কি করা হয়- এমন প্রশ্নে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা বলেন, এ টাকা আশিকস (আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ শিক্ষক-কর্মচারী সমিতি) নেয়।
একই কথা বলেন মীরহাজীরবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘মুনাফার টাকা স্কুলের শিক্ষক কল্যাণ সমিতিতে দেওয়া হয়।’
তবে এ ব্যবসায় পিছিয়ে নেই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোও। রাজধানীর কিন্ডারগার্টেনগুলো বেতন-ফি ছাড়াও বই-খাতা এবং পোশাকের রমরমা ব্যবসা করছে। সরকারি তদারকির অভাবে অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে থাকা এ শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা দোকানের আদলে খেয়াল-খুশি মতো ব্যবসা করছে।
বাড্ডা লিংক রোডের সানশাইন মডেল স্কুলটিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের নির্ধারিত তিনটি বইয়ের বাইরে আরও পাঁচটি সহায়ক বই দেওয়া হচ্ছে। এই বইয়ের জন্য নেওয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। প্রতিটি বইয়ের জন্য হোম ওয়ার্ক এবং ক্লাস ওয়ার্ক হিসেবে দুটি করে খাতা কিনতে হয়। ৫০ টাকা পিস হিসেবে এক সেট (১৬ পিস) খাতার দাম নেওয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। অথচ একই খাতা বাজারে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছরে দুটি করে ডাইরি নিতে হয়, যার দাম ২০০ টাকা। এছাড়াও বইয়ের মধ্যে থেকে আবার শিট তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে নতুন কৌশলে টাকা।
এ বিষয়ে লিংক রোডের স্টেশনারী ব্যবসায়ী মো. রফিক ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো নিজেরাই বই-খাতাসহ আনুষাঙ্গিক বিক্রি করে। এর ফলে আমাদেরও বেচা-কেনা কমে গেছে। আমরা যে খাতা ৬০ টাকা বিক্রি করি, তারা সেটার দাম নিচ্ছে ১০০ টাকা। পার্থক্য হলো, তারা বই-খাতার মলাটে নিজের স্কুলের নাম দিচ্ছে। তবে এর জন্য খরচ বাড়ে তিন/চার টাকা। কিন্তু বাড়তি নিচ্ছে প্রায় ৪০ টাকা। তারপরও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাধ্য হয়ে সেখান থেকেই সেগুলো নিতে হচ্ছে।’
মহাখালীর মায়ের-দোয়া কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাইস্কুল, গুলশানের চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুল, ধলপুরের রোজ গার্ডেন হাই স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুলের তথ্যমতে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, গণিতের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ধর্ম, পরিবেশ-পরিচিতি, বিজ্ঞান, ওয়ার্ড বুক, চিত্রাঙ্কণ, বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা শেখা, সাধারণ জ্ঞান, ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, গল্প ও কবিতার এবং কম্পিউটার শিক্ষা সংক্রান্ত বই দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুলভেদে এসব বইয়ের সংখ্যা ও বিষয় কম-বেশি হয়ে থাকে।
তবে মায়ের দোয়া কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাই স্কুলের পরিচালক ও বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স এসোসিয়েশনের অর্থ সচিব মো. মাহমুদ হাসানের মতে, শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্যই বই-খাতা বা পোশাক বানানোর দায়িত্ব নেওয়া হয়।
আর বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের সহকারী শিক্ষা সম্পাদক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।’
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রাক-প্রাথমিক) মহিউদ্দিন আহমেদ তালুকদার ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে বাড়তি বই দেওয়ার কোন বিধান নেই। কিন্তু কিছু বেসরকারি স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেনগুলো অবৈধ ভাবে এই বাণিজ্য করছে। তাদের অবৈধ এ শিক্ষা বাণিজ্যের বিষয়ে আমরা অবগত রয়েছি। অধিদপ্তর অর্ডার দিয়েছে, খুব শীঘ্রই আমরা এ্যাকশানে যাব।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপ-পরিচালক সেলিনা জামান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে কারও চলার সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক স্কুলেই বাড়তি বই পড়ানো হচ্ছে বা বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।’
এদিকে, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফালোভী হয়ে পড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভোক্তা-অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাণিজ্য বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
তাদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুনাফালোভী হয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন এবং বেসরকারি স্কুলগুলোতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিষয়ে বেশি অনিয়মের অভিযোগ আসছে। এ বিষয়ে আমরা এর আগেও অভিযান চালিয়েছি। ভোক্তা-অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে এ বিষয়ে আমরা খুব দ্রুতই প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবো।’
এর আগে গত বুধবার (২১ ডিসেম্বর) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চার জন উপ-সচিবের নেতৃত্বে চারটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা সরকারি, বেসরকারি স্কুল এবং বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি, ভর্তি ফি, উন্নয়ন ফিসহ অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যথাযথ ভাবে গ্রহণ করছে কি না বা অন্য কোন মাধ্যমে টাকা নিচ্ছে কি না – তা সরেজমিনে যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করছেন।