বগুড়ায় সংসারের পাশাপাশি ‘জালি টুপি’ তৈরিতে সংযুক্ত রয়েছেন অন্তত আড়াই লাখ নারী। বিজিলেস স্ট্যান্ডার্ডের মাধ্যমে জানা যায়, তারা প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ টুপি তৈরি করেন। এসব টুপি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, শুধু বগুড়ায় বছরে অন্তত ২০০ কোটি টাকার টুপি তৈরি হয়। এর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হয়।
বাংলাদেশ জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক আগে থেকেই দেশের বাহিরে টুপি রপ্তানি হচ্ছে। আমরা বতর্মানে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কাতার, দুবাই, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টুপি করি। এই টুপি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় ব্যাপক বাজারও গড়ে উঠেছে। তারা দেশ ও দেশের বাহিরে বিভিন্ন জায়গায় টুপি বিক্রি করে থাকেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বগুড়া থেকে ৮-১০ জন ব্যবসায়ী টুপি রপ্তানি করেন। এদের মধ্যে জুয়েল আকন্দের ‘জুয়েল ক্যাপ ডিপো’ অন্যতম। এ ছাড়া রিপন ক্যাপ প্রোডাক্টস, মাহফুজ ক্যাপ ডিপো, ইলিয়াস ক্যাপ প্রোডাক্টস, হক ট্রেডার্স, জাহিদ ক্যাপ ডিপো, এসএস ক্যাপ, আবদুল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সের নাম রয়েছে বাংলাদেশ জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায়।
টুপির কর্মজজ্ঞকে ঘিরে কুটির শিল্পের আদলে নানামুখী কারখানাও গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কেউ টুপি রপ্তানির প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তুলেছেন। কেউবা টুপির উপযোগী সুতা তৈরি কারখানা স্থাপন করেন। অনেকেই টুপি ধোলাইয়ের জন্য কারখানা গড়ে তুলেছেন।
ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা জানান, টুপি তৈরি করতে বেশি পুঁজির দরকার হয় না। এর জন্য সুতা কিনতে হয়। সুতা পাওয়া যায় ববিন আকারে। প্রতি ববিন সুতার দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এক ববিন সুতায় ১৫ থেকে ২২টি টুপি হয়। একটি টুপি তৈরি করে হাতে আসে গড়ে ৩৫ টাকা। একজন নারী বা কারিগর সংসারের কাজ করে ১০টি পর্যন্ত টুপিও তৈরি করতে পারে। গড়ে তাদের প্রতিদিন আয় হয় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। প্রতি টুপি ২০ থেকে ৮০ টাকা করে বিক্রি হয়। আর ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কাতার, দুবাইয়ে এসব টুপিই ৪০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হয়।
প্রায় চার দশক আগে বগুড়ার ধুনট উপজেলার নিমগাছী গ্রামে কয়েকজন গৃহবধু কুরুশকাঁটা দিয়ে টুপি তৈরি শুরু করেন। প্রথম দিকে এই টুপিগুলো বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে গেল শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয়। এতে গৃহবধূরা বাড়তি আয়ের জন্য টুপি তৈরি শিখে তার উৎপাদন বাড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে ধুনট উপজেলার সীমানা ছাড়িয়ে তা পাশের শেরপুর উপজেলার গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। গৃহবধুদের পাশাপাশি তাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও কিশোরী মেয়েরাও টুপি তৈরিতে মনোযোগী হন।
ক্রমাগত এই টুপি তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়েছে বগুড়ার শেরপুর, ধুনট, সদর, শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ, কাহালু, নন্দীগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে। টুপি তৈরি করেন নারীরা। এসব গ্রামে অন্তত আড়াই লাখ নারী টুপি বুননে জড়িয়ে আছেন। টুপি তৈরি করে অনেক নারী সংসারের হাল ধরেছেন। কেউবা দারিদ্রতা ঘুচিয়েছেন।
অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে টুপির চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে শব-ই বরাতের পর থেকে পরবর্তী এক মাসে দ্বিগুণ বেশি উৎপাদন হয় টুপি। এই সময়ে আয়ও বেড়ে যায় নারীদের। এবার করোনার প্রভাব টুপি শিল্পেও পড়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার কারণে ফের কর্মচঞ্চলতা বেড়েছে টুপির গ্রামগুলোতে।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার পূর্ব ভরনশাহী গ্রামের রঞ্জনা বেগম (৩৫)। তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে টুপি তৈরি করেন। তার স্বামী আরিফুল ভ্যানচালক। দুই সন্তানের জননী রঞ্জনা বাড়ির উঠানে টুপি তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে পাইকারী ব্যবসায়ীদের টুপি কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন ঈদকে সামনে রেখে টুপি ব্যবসায় কিছুটা জোয়ার এসেছে। ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করছেন আমাদের সাথে’।
একই গ্রামের বাসিন্দা লতা বেগম (৩৬)। তিনি টুপির তৈরি কাজ শুরু করেন স্কুল শিক্ষার্থী থাকাবস্থায়। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুনোর আগে গ্রামেই বিয়ে হয় তার। এখন লতা পুরোপুরি গৃহিনী। পাশাপাশি টুপি তৈরির কাজ করেন। তিনি বলেন, সংসারের পাশাপাশি টুপি তৈরি করে ভালো আয় করা যায়। দিনে সাত থেকে আটটা টুপি তৈরি করেন তিনি। এতে প্রতিমাসে তার আট থেকে ৯ হাজার টাকা আয় হয়।
শেরপুর উপজেলার শালফা এলাকার কলেজশিক্ষার্থী আনিকা খাতুন। কলেজ বন্ধ থাকায় তিনি বাড়ি এসে টুপি তৈরি করছেন। ১৯ মার্চ থেকে কলেজ বন্ধ রয়েছে আনিকার। তিনি বলেন, কলেজ বন্ধ হওয়ার পর বাড়ি এসে টুপি তৈরি শুরু করি। করোনার কারণে পাইকারি ক্রেতারা গ্রামে কম আসছেন। তবে ঈদের আগে এই ব্যবসা জমজমাট হবে। বর্তমানে টুপি তৈরি করে মাসে তিনি প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করছেন। এতে আগামী কয়েকমাস তার পড়াশোনার খরচ চলবে বলে জানান।
স্বামী আব্দুল করিম ১০ বছর আগে মারা যাওয়ার পর থেকে টুপি তৈরি করে সংসারের হাল ধরেছেন শেরপুরের চৌবাড়িয়া গ্রামের আয়েলা বেগম (৫০)। তিনি বলেন, ‘এই টুপি তৈরি করে এক মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছি। আমার সংসারের অভাব ঘুচিয়েছে টুপির কাজ’।
একই গ্রামের আশা বেগম (৪১) তার স্বামী আব্দুল লতিফের উপর নির্ভরশীল ছিলেন ৫ বছর আগেও। এখন কোনো কিছু কিনতে হলে আর স্বামীর কাছে ধর্না ধরতে হয় না। আশা বলেন, ‘নারীরা সাধারণত অবহেলিত হয়। কিন্তু আয়ের পথ থাকলে প্রতিটি নারীর নিজের উপর আত্মবিশ্বাস থাকে। নির্যাতন সয়ে বেঁচে থাকতে হয় না। আমাদের গ্রামের টুপিশিল্প আয়ের পথ উন্মোচন করে নারীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে’।
বাংলাদেশ জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মুকুল হোসেন জানান, এই শিল্পে জেলা জুড়ে অন্তত আড়াই লাখ নারী কাজ করেন। তারা প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ টুপি তৈরি করেন। শুধু বগুড়ায় বছরে অন্তত ২০০ কোটি টাকার টুপি তৈরি হয়। অধিকাংশই রপ্তানি করা হয়। তবে গত বছর করোনার কারণে টুপি ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে। কিন্তু এই অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সামনে ঈদকে সামনে রেখে আবার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে টুপিশিল্প। নারীদের কুটির শিল্পকে বিকশিত করা গেলে এই শিল্প আরও বিস্তার লাভ করবে দেশ-বিদেশে।
জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জুয়েল আকন্দ বলেন, কিশোর বয়স থেকেই টুপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন জুয়েল। আগে তিনি বগুড়ার বিভিন্ন মসজিদে টুপি বিক্রি করতেন। এখন তার অবস্থা বদলে গেছে। স্কুল জীবনেই তিনি ঢাকার চকবাজারে টুপি বিক্রি শুরু করেন। এখন দিন পাল্টে তিনি টুপির রপ্তানিকারক হয়েছেন। দেশের বাহিরে তিনি প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকার টুপি বিক্রি করেন।
জুয়েল আকন্দ আরও বলেন, ‘২০০৪ সালে মেশিন কিনে সুতা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা দিলাম। ২০০৫ সালে রপ্তানিযোগ্য টুপি প্যাকেজিংয়ের জন্য ধোলাই কারখানা স্থাপন করি। এখন ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টুপি বিক্রি করি’।
টুপি শিল্পের সাথে জড়িত নারীদের ঋণ দেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে বগুড়া বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুটির শিল্পের আদলে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো ঋণ সহায়তা নেওয়ার জন্য আমাদের কাছে আসে না। এমনকি সরকারি প্রনোদনা দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও লোকজন পাওয়া যায় না। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও একই। তবে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিলে ভালো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে’।