‘দেখছে না কেউ লাল শিখা
দেখছে না ধোঁয়ার রেখা
লাগছে লাগছে বাজারে আগুন
দাম মিয়া ‘ছেঁড়া ঘুড়ি’
ঊর্ধ্বগগনে বাজায় তুড়ি
হচ্ছে হচ্ছে স্বস্তি, ঘুম খুন। ’
-(বাউল আউছি খাঁ)
সত্যি নিত্যপণ্যের বাজার এমনই বেহাল অবস্থা। যে কয়টি উদ্ধারহীন সমস্যায় সাধারণ মানুষ যুগ যুগ ধরে কাতরাচ্ছে, এর একটি হলো এই দ্রব্যমূল্য। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, রমজান, কোরবান লাগে না। এ দেশে পান থেকে চুন খসলেই দামের গরুটা আকাশে চড়ে বসে। কারণ বা যুক্তি লাগে না, ঠুনকো ‘ছুতা’ বা অজুহাত পেলেই হলো। এমনিই দামের পারদটা ওপরে উঠে যায়। দেশীয় ব্যবসায়ীরা এতটাই সংঘবদ্ধ যে- তারা ‘চাহিবামাত্র’ এখানে নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ধরে যায়, তৈরি হয় কৃত্রিম সংকট। তাদের ইশারায় যখন-তখন লাটে উঠে মানুষের জীবন। তাদের অঙ্গুলি হেলনে দুই মুঠো ডাল-ভাত জোগাতেই মানুষের হয় জান ‘যায় য়ায়’ অবস্থা। দামের এই খেলা যে অসাধু ব্যবসায়ীদের খেয়ালখুশির একটা খেলা, তা ব্যবসায়ীদের স্বয়ং নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যেই পরিষ্কার।
গত রবিবার বাজার পরিস্থিতির ওপর এক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন ব্যবসায়ীদের সুযোগের অপব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এত লাভ করতে হবে কেন? আমরা ব্যবসা করব। কিন্তু এমন কিছু করব না- যাতে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ওপর দোষ বা বদনাম চলে আসে।’ পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি করাকে ‘ব্যবসায়ীদের কারসাজি’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে যেদিন পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হলো, সেদিন বিকেলেই প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ১০-১৫ টাকা কমে গেল। শুল্কমুক্ত সুবিধায় পেঁয়াজ আমদানির আগেই দাম কমানোর মানে হলো দামটা আগেও কমানোর সুযোগ ছিল।’ এফবিসিসিআই সভাপতি ওই সভায় ব্যবসায়ীদের জবাবদিহির মধ্যে আনার পরামর্শও দেন (তথ্য সূত্র জাতায় দৈনিক)।
দামের পাগলা ঘোড়ার লাগাম যে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের হাতে, তা খোদ সরকারি গবেষণাতেও উঠে এসেছে। চাল, আলু আর পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) বলছে, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে চাল, আলু আর পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। বিএআরসি উপস্থাপিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত চালের মজুদ ছিল না। তা ছিল মিলারদের হাতে। ফলে তারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চাল ছাড়েনি। সরকারের হাতে যদি পর্যাপ্ত চাল থাকত, তা হলে ওএমএসের মাধ্যমে বাজারে ছেড়ে নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আলুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এটা তো সরকারের হাতে থাকে না। থাকে কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যবসায়ীদের কাছে। বন্যার কারণে যখন সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন আলুর ওপর চাপ পড়ে। আলুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, তখন কোল্ড স্টোরেজ থেকে পর্যাপ্ত আলু বাজারে ছাড়া হয়নি। অথচ সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত আলু আমাদের রয়েছে। এখানেও সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আলু বাজারে আনতে পারেনি। আর পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে। কিন্তু ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় বাজারে সংকট তৈরি হয়। তখন অন্য জায়গা থেকে দ্রুত আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
সাধারণ মানুষের জীবনধারণ ও বেঁচে থাকা যেন আজ কার্যত কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি। দুঃখের বিষয় হলো, তার পরও সরকার সাক্ষীগোপাল। উল্টো শুনি, এই গনগনে দামের আগুনেও সরকার ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আবারও সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৭ ও পাম তেল ৩ টাকা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে। যুক্তি বিশ^বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি। একই যুক্তিতে চিনির দামও নাকি বাড়তে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সাফ কথা- ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে সরকারের কিছুই করার থাকে না’। প্রশ্ন হলো, বিশ^বাজারে দাম বৃদ্ধির তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে, পণ্য আমদানির আগেই এ দেশে পুরনো মজুদের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু বিশ^বাজারে দাম কমলেই এখানে পণ্যের দাম কি সঙ্গে সঙ্গে কমে? সম্প্রতি বিশ^বাজারে চালের দাম কমেছে। কই, এখানে তো এর প্রভাব পড়েনি। কই, এখানে চালের দাম তো খুব এক টাকা কমেনি। মুক্তবাজার অর্থনীতির মর্মার্থ কি এই, ভোক্তারা শুধু নিষ্পেষিত হবে? আর সরকার শুধু ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম’ গান গাইবে? সরকারের কাজ কি শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা? যাদের ভোটে তারা নির্বাচিত- তাদের ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্ট কি তাদের কাছে কোনো আবেদন বহন করে না?
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার ব্যবস্থাপনা, তদারকির জন্য তাত্ত্বিকভাবে বাণিজ্য মন্ত্রলাণলয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল, খাদ্য অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ সরকারের একাধিক বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা যেই লাউ, সেই কদু। মাঝে মধ্যে বাজার পরিদর্শন, শহরাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কিছু অভিযান-জরিমানা- এর নামই কি বাজার ব্যবস্থাপনা? কিছু বাজারে দ্রব্যমূল্যের তালিকা ঠানিয়ে দেওয়ার নামই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ?
লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাজারে অতিরিক্ত মুনাফাকারী, অননুমোদিত পরিমাণে পণ্য গুদামজাতকারী, অবৈধ আড়তদার, সংগঠিত সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত যারা নানা উপায়ে পণ্যের দাম অস্থিতিশীল করে- তাদের প্রতিরোধে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন-পুরনো আধা ডজনেরও বেশি আইন রয়েছে। পুরনো আইনগুলোর মধ্যে ঞযব ঊংংবহঃরধষ অৎঃরপষবং (চৎরপব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ অহঃর-ঐড়ধৎফরহম) অপঃ. ১৯৫৩; ঞযব ঈড়হঃৎড়ষ ড়ভ ঊংংবহঃরধষ ঈড়সসড়ফরঃরবং অপঃ. ১৯৫৬, ‘অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৮১’, ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১’ অন্যতম। কিন্তু এসব আইন এখন অনেকটাই ‘কাগুজে বাঘ’। নতুন আইনের মধ্যে ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২০ অন্যতম। অনেক বড় আশা ও স্বপ্নের সাইরেন বাজিয়ে আইনগুলোর জন্ম হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক আইনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ছিল দেশব্যাপী। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আইনগুলোর প্রয়োগ যেমন সীমিত, তেমনি গড়ে ওঠেনি নেটওয়ার্ক বা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োগকারী সংস্থা। তবে জনবল কম, আছে সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন। ভাবতে অবাক লাগে, দ্রব্যমূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণে এত আইন থাকার পরও এ দেশের কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্যে পুরো দেশে যুগ যুগ ধরে নিত্যপণ্যের বাজার অরাজকতা ও নৈরাজ্য চলছে, মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। যা খুবই হতাশাজনক।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বর্তমান সরকারের অবদান নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের অবস্থা বা অবস্থান ঠিক ততটাই বিপরীত। এ জায়গায় সরকারকে কোনো অর্থেই সফল বলা যাবে না। অথচ সরকার ‘উন্নয়ন’-এ যতটা মনোযোগী ও আন্তরিক, এর দশ ভাগের এক ভাগ মনোযোগ যদি নিত্যপণ্যের বাজারের অরাজকতা দমনে দিত- তা হলে হয়তো ১৭ কোটি মানুষের আজকের এই ‘ত্রাহি ত্রাহি’ অবস্থা হতো না। উন্নয়ন অবশ্য দরকার। উন্নয়ন তো জীবনের জন্য। জীবন যদি না বাঁচে, তা হলে ‘উন্নয়ন’ কি তার মর্যাদা হারায় না? এ দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া তো বেশি কিছু নয়। পেটে দুইবেলা ডাল-ভাত জোগাতে পারলেই তারা খুশি। একদিকে করোনা মহামারী থাবায় সবার অনিশ্চিত ও শঙ্কিত জীবন-জগৎ, অন্যদিকে লাখো মানুষের বেকারত্ব ও চাকরিহীনতা। ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ নিত্যপণ্যের দামের উল্কাগতি। তা হলে মানুষ যাবেটা কোথায়? তারা বাঁচবে কীভাবে? বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ জোগাতেই যেখানে তারা গলদঘর্ম, সেখানে উন্নয়নের এই ‘ভরা জোয়ার’ তাদের মুখে কি হাসি ফোটাতে পারবে? তা ছাড়া জীবনের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে এর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। জীবনধারণের অধিকারের সঙ্গে জীবনের অপরিহার্য মৌলিক চাহিদা (খাদ্য) পূরণের অধিকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সংবিধানের রক্ষক হিসেবে সরকার মানুষের ‘জীবন’-এর নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য। ওই হিসাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় অপরিহার্য খাদ্যপণ্যের মূল্য (যেমন- চাল, ডাল, পেঁয়াজ, সবজি, তেল, চিনি, আলুসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য) নিয়ন্ত্রণেও সরকার সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এ দায়িত্ব পালনে শিথিলতা বা উদাসীনতা কার্যত জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
আমরা বিশ^াস করি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল লোকজন নিজেদের দায়িত্ব ও আইনগত বাধ্যবাধকতা বুঝতে সক্ষম। সরকার আশা করি, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম স্থায়ীভাবে টেনে হতভাগ্য ও অসহায় জনগণকে বাঁচার সুযোগ দেবে এবং তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। জনগণের জন্য এটিই হবে প্রকৃত, সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে জরুরি উন্নয়ন।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট