।। নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
আসছে শীত। ঢাকা এখন হয়ে যাবে ধুলোর শহর। চলাফেরা হয়ে উঠবে অসম্ভব। দূষণ দুর্ভোগ পোহাতে হবে কোটি কোটি মানুষকে। ঢাকার পরিবেশ নিয়ে কথা কম হচ্ছে না। এ বছরের আগস্টেই ঢাকা পেয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ বসবাসের অযোগ্য শহরের তকমা। সামনে আছে কেবল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। বাস্তবতা হলো, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে থাকায় দামেস্কে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার সুবাদে ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে যেতে পেরেছে। দামেস্কের অবস্থাকে ‘বিশেষ’ আখ্যা দেয়া যায়। সেখানে এমন বিশেষ অবস্থা না থাকলে ঢাকাই হতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স-২০১৮’ প্রকাশিত তথ্য ঢাকার এমন জঘন্যতম চিত্রই নির্দেশ করছে। কিন্তু ঢাকার এমন দশার কারণ কী? কেন শহরটি দিন দিন এমন অধঃপতনের দিকে ছুটছে?
‘দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স-২০১৮’ কী বলছে, প্রথমে সেদিকে নজর দেয়া যাক। প্রতিবেদন বলছে ঢাকার মতো খারাপ অবকাঠামো বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে আর একটিরও নেই। এমনকি সিরিয়ায় এত যুদ্ধবিগ্রহ চললেও, অবকাঠামোর দিক থেকে ঢাকা আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্কেরও নিচে। সড়ক নেটওয়ার্ক, গণপরিবহন, আবাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা, পানি সরবরাহ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার মান বিবেচনায় এই সূচকটির হিসাব করা হয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পেয়েছে একশোর মধ্যে মাত্র ২৬.৮। বিপরীতে দামেস্ক পেয়েছে ৩২.১, নাইজেরিয়ার লাগোস ৪৬.৪, পাকিস্তানের করাচি ৫১.৮ ও পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবি পেয়েছে ৪৬.৪। এই শহরগুলো আছে বসবাসের অযোগ্য তালিকার শীর্ষে।
ঢাকার অবকাঠামো কেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্কের চেয়েও খারাপ। এত উন্নয়নের আওয়াজ তাহলে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে? শুধু এই সরকার নয়, আগের সরকারগুলোই বা কোথায় মুখ লুকোবে। অবকাঠামো খারাপ হওয়ার অর্থ হলো, ঢাকায় পর্যাপ্ত রাস্তা-ঘাট নেই, রাস্তাগুলোর মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ সড়কই ভাঙাচোরা, উন্নয়নের জন্য কাটা ফাড়া অবস্থায় থাকে বেশির ভাগ সময়। অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়।
গণপরিবহন যে ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে আছে, সেটা কাউকে বলার প্রয়োজন নেই। স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এই সমস্যা সমাধান করতে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু গণপরিবহনের সংকট সমাধানের চেয়ে সরকার আগে তাদের ঘরে পাঠানোর ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলত গণপরিবহনের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে আগের চেয়ে।
আবাসনের ক্ষেত্রে ঢাকা তো যাচ্ছে তাই, অসংখ্য মানুষ রাস্তায় থাকেন। রাষ্ট্রপতির বাড়ি বঙ্গভবনের প্রধান ফটকের উল্টো দিকে অবস্থিত গুলিস্তান পার্কে হাজারো মানুষ খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করেন। বাসাবাড়ি আছে, তবে সেগুলোর ভাড়া মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নির্ধারণ করা হয় না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য মানুষকে চড়া মূল্য দিতে হয়। তবু অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বা গ্যাস পাওয়া যায় না। বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা নিয়েও রয়েছে হাহাকার। পয়ঃনিষ্কাশন, রাস্তায় ময়লা পানি জমে থাকা, অল্প বৃষ্টিতেই সড়ক তলিয়ে যাওয়া, এগুলো ঢাকার নিত্যসমস্যা।
তবে যানজট সমস্যা এত প্রকট হয়েছে যে, এর সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। যেখানে মানুষের হাঁটার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার, সেখানে ২০১৬ সালে ঘণ্টায় ঢাকার গড় গতি ছিল মাত্র ৬.৪ কিলোমিটার। নিঃসন্দেহে এখন তা আরও নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, ঢাকার মৃত্যু ঘটেছে। শক্তিশালী ইনজেকশন দিয়ে আইসিইউতে রেখে জীবন কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু বসবাসের নগরীতে ঢাকাকে ফিরে আনার আর কোনো সুযোগ নেই।
বিশেষজ্ঞরা নানা সময় দাবী করেছেন, সরকারগুলোর ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনাই ঢাকাকে ডুবিয়েছে। তারা না পেরেছে শহরে সুব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে, না পেরেছে ঢাকার পরিকল্পিত সম্প্রসারণ ঘটাতে, না পেরেছে রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নিতে। বিপরীতে ঢাকার এমন অপরিকল্পিত বিকাশ ঘটানো হয়েছে যে, এই শহরের সমস্যা সমাধানের কোনো রাস্তা আর বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না।
‘রাজউক’ ছিল ঢাকার উন্নয়নের দায়িত্বে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিকে নিজ আয়ে চলার বিধি দিয়ে এমন সব প্রকল্পের দিকে চালিত করা হয়েছে, যা ব্যক্তিবিশেষের মুনাফা বৃদ্ধিতে কাজে লাগলেও ঢাকার উন্নতির কোনো কাজ তাতে হয়নি। সরকারগুলোর দায়িত্ব ছিল ঢাকাকে চাপমুক্ত করা। সেক্ষেত্রে নগরের বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির পাশাপাশি উচিত ছিল রেল ও নৌপথ উন্নয়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। কিন্তু রেল বরাবরই অবহেলায় ছিল, আছে। আর নৌপথ তো দিন দিন কমছে, ঢাকার পরিসর সংকীর্ণ হওয়ার গতিতেই।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. সামছুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘উন্নয়ন প্রশ্নে স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ দাতানির্ভর। অর্থ সাহায্য করে দাতাদেরও তো কিছু না কিছু গোপন শর্ত থাকে। দাতারা দেখেছে, সড়ক বানালে তাদের গাড়ি বিক্রি হবে।… সরকারগুলো জনপ্রিয়তার দিকে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জনগণ চায় ঘরে ঘরে সুবিধা, সরকার চায় ভোট এবং দাতারা চায় গাড়ি বিক্রি। তিনটিই সড়কে মেলে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে সরকার কৌশলী হলে জনপ্রিয়তাকে এভাবে গুরুত্ব দেয়ার দরকার পড়ে না। সস্তা জনপ্রিয়তা, বিনিয়োগের গোপন এজেন্ডার কারণে কখন যে মানুষ ভুলে গেল যে, রেলের একটি অমিত সম্ভাবনা ছিল।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক, বর্ষ ৮, সংখ্যা ৯)
উপরোক্ত মন্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশে পরিবহন, যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো নীতিগত পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং নিজেদের মুনাফার উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখানকার কর্তৃপক্ষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, করে চলেছে। রাজনীতিকদের দায়ও অস্বীকার করা যায় না। এই শহরের এমন দশা তো একদিনে হয়নি। নাগরিকদের চোখের সামনেই এসব ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা আন্দোলন হলেও ঢাকার দুর্দশা নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক কিছু হয়নি। এসব কারণেই ঢাকা আজ এমন নিকৃষ্ট অবস্থায় চলে গেছে।
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে, এখানে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সরকারের নীতিগত পর্যায়ে যেমন মৌলিক পরিবর্তন দরকার, তেমনি নাগরিকদের, ভোক্তাদেরও সচেতন ও সংগঠিত হওয়া দরকার। জাতিসংঘ স্বীকৃত ৮টি ভোক্তা অধিকারের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজ করার অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।