চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি
ভোজ্য তেল নিয়ে সারাদেশে অস্থিরতার মধ্যে এবার দাম বেড়েছে পেঁয়াজ ও রসুনের। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ১২-১৪ টাকা ও রসুনে ১৮-২০ টাকা বেড়েছে।
ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের পাশাপাশি ডলারের দামের উর্ধ্বগতির কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, আগামী কোরবানি ঈদে বাজারে পেঁয়াজ রসুনের কোনো সংকট হবে না।
তবে দেশের কৃষকদের উৎসাহিত করতেই সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি সাময়িক বন্ধ রেখেছে বলে জানান তারা।
রান্নায় মসলার অন্যতম উপকরণ হিসেবে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। তাই সব স্তরের মানুষের মাঝে এসব ভোগ্যপণ্যের সমান চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজ, রসুন ও আদার উৎপাদন কম হয়। অতিরিক্ত চাহিদার এসব ভোগ্যপণ্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটাতে হয়।
চট্টগ্রাম মহানগরীর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে রসুনের দাম বেশি থাকলেও পেঁয়াজের দাম ছিল বছরের অন্য সময়ের চেয়ে কম। দেশে আমদানিকৃত পেঁয়াজ আসে ভারতের মহারাষ্ট্র ও গুজরাট থেকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি (আইপি) না থাকায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি এখন বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমেছে। এই দুই কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
তারা জানান, ঈদের আগে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে ভালো মানের প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৪-২৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রসুন বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা কেজি দরে। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা কেজিতে। অন্যদিকে, রসুন বিক্রি হচ্ছে ১১৪-১১৫ টাকা কেজিতে। তবে পেঁয়াজ ও রসুনের তুলনায় আদার দাম কম আছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
মধ্যম চাক্তাইয়ের পেঁয়াজ রসুনের আড়তদার বশর অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী হাজী আবুল বশর বলেন, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজ উৎপাদনের মৌসুম চলছে। এখন ফলন উঠছে। ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে থাকলে দেশীয় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খরচ অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম পান না কৃষকরা।
‘ঈদের আগে ভারতীয় পেঁয়াজ ২৪-২৫ টাকা থাকলেও দেশীয় পেঁয়াজ ২০-২২ টাকাতেও বিক্রি হয়নি। এমনও সময় গেছে, দেশীয় পেঁয়াজ ১০ টাকা কেজিতেও বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এখন ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় আড়তে দেশীয় পেঁয়াজ ৩৪-৩৫ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ না থাকলে লোকজন দেশীয় পেঁয়াজ কিনবে। এতে এই পেঁয়াজের বাজার ভালো থাকবে।’
এদিকে, পেঁয়াজ-রসুন ব্যবসায়ে কোনো সিন্ডিকেট নেই বলে দাবি করেন খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ-রসুনের আড়তদার ব্যবসায়ী এস এন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলী হোসেন খোকন। তিনি বলেন, পেঁয়াজ রসুন পচনশীল পণ্য। কেউ দাম বাড়ানোর জন্য পেঁয়াজ রসুন স্টক করতে পারে না।
‘এক বস্তা পেঁয়াজ গুদামে রাখা হলে এক দিনেই ৫০০ গ্রাম ওজন কমে যায়। বেশিদিন রাখলে পচনও ধরে। যে কারণে সিন্ডিকেট মজুদদারী করে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। গত সপ্তাহে দাম কিছুটা বাড়লেও গতকাল শনিবার থেকে দাম কমতির দিকে রয়েছে।’
হামিদ উল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, সরকার দেশীয় কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছে। দাম কিছুটা বাড়লে হয়তো আবার আমদানির অনুমতি দিয়ে দেবে। আগামী কোরবানিকে সামনে রেখে পেঁয়াজ রসুনের কোনো সংকট হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ সালের জন্য পেঁয়াজের চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টন। যা আগের ২০২০-২১ সালে ছিল ৩৫ লাখ টন। এভাবে প্রতি বছরই চাহিদা বাড়লেও দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়েনি। তার ওপর মৌসুমী দাম না পাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণও ফলন না বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদন নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের গড়মিল রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে ১৯-২০ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ দেশে উৎপাদিত হয়।
আবার দেশে রসুনের চাহিদা বছরে পাঁচ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে দেশেই উৎপাদিত হয় চার লাখ টনের কিছু বেশি। চাহিদার অতিরিক্ত রসুন বেসরকারিভাবে চীন থেকে আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটান ব্যবসায়ীরা।
চলতি বছর পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদনের (আইপি) মেয়াদ শেষ হয় গত ২৯ মার্চ। কিন্তু রমজানে দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ৫ মে পর্যন্ত আইপির মেয়াদ বাড়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ৬ মে থেকে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে।
ভোমরা স্থল বন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক আবদুল আজিজ বলেন, সরকার আইপি বন্ধ করে দেওয়ায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দাম হঠাৎ করে বেড়েছে। তবে ভোমরার গোডাউনগুলোতে ঈদের আগের পেঁয়াজ এখনও আছে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি ও রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ বলেন, ঈদের আগে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল। ঈদের আগে কেনা পেঁয়াজ ভোক্তা পর্যায়ে এখনও রয়ে গেছে। ঈদের পর স্বাভাবিকভাবে চাহিদা কম থাকে। তাই এখন বাজারে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। আইপি বন্ধ রাখায় এখন দাম কিছুটা হয়তো বেড়েছে। তবে এটি সাময়িক বলে মন্তব্য করেন এ ব্যবসায়ী।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মো. মহিউদ্দিন বলেন, ভোগ্যপণ্যের জন্য আমরা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছি। এটি দেশের জন্য খুবই হতাশার। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের খাদ্য চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে। আবার ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বাড়ছে। এর প্রভাবে পেঁয়াজ-রসুনের দামও বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।