ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক
নামিদামি প্রতিষ্ঠানের নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলে।যা বিশেষজ্ঞ ও প্রস্তুতকারক ছাড়া কারও চেনার উপায় থাকে না। কম দামে কিনে অসাধু কিছু ফার্মেসির মালিক তা বিক্রি করছেন।
অসাধু ফার্মেসির মালিক ও নকল ওষুধ তৈরির চক্রের খপ্পরে পড়ে দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকা থেকে নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী একটি চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করা হয়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সক্ষমতা অনুযায়ী চাহিদার ৯৫ শতাংশ ওষুধের জোগান দিচ্ছে প্রস্তুতকারক দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
এছাড়া আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ বিশ্বের ১৫৬টি দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি ২০১৮ সালে ‘মেডিসিন প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।
তবে, এত সক্ষমতা অর্জন সত্ত্বেও বাজারে কেন ছড়াচ্ছে নকল ওষুধ, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরও।
প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সমন্বয় করে অভিযান চালাচ্ছে। অধিদফতরও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তবে, জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট কম থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর আগে রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় নকল ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান মেলে। পরে প্রতিষ্ঠিত ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের ভিত্তিতে এসব কারখানায় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযানের পর ভেজাল ওষুধ তৈরির কার্যক্রম কিছুটা কমলেও নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ফের তা শুরু হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ভেজাল ওষুধ কারবারি চক্রের প্রধান টার্গেট ঢাকা। রাজধানীর মিটফোর্ড ও এর আশপাশের এলাকায় তারা কারখানা গড়ে তোলে।
পরবর্তীতে চাহিদা বাড়তে থাকায় কুমিল্লা ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠে কারখানা। এসব কারখানার তৈরি নকল ওষুধ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
যেভাবে গ্রামে গ্রামে যাচ্ছে নকল ওষুধ
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, নকল ওষুধ প্রস্তুতকারক চক্রটি বাজারে কোন ধরনের ওষুধের ব্যবহার বেশি তা আগে রেকি করে জানার চেষ্টা করে। পরে সেগুলো হুবহু তৈরি করে।
বাজারজাতের জন্য প্যাকেটের সিকিউরিটি হলোগ্রামও নকল করে তারা।
চক্রটি পরে বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও নিজেদের কর্মীদের দিয়ে ফার্মেসির মালিকদের সঙ্গে কম দামে সরবরাহের মৌখিক চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী নকল ওষুধের চালান ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলের ফার্মেসিগুলোতে।
গ্রেফতার হওয়া এ চক্রের একাধিক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং পুলিশের তদন্তে জানা যায়, ওষুধের ধরন ও প্যাকেটজাতের প্রক্রিয়া ছাড়া আসলের সঙ্গে নকল ওষুধের উপাদানগত কোনো মিল নেই।
প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো যেসব নীতিমালা ও প্রক্রিয়া মেনে ওষুধ তৈরি করে, তারা এর কিছুই মানে না। তাদের নেই কোনো কেমিস্ট বা ফার্মাসিস্ট।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে ওষুধের মান নিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি নাগরিকদের হাতে যেন সঠিক ওষুধ পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করা।
কিন্তু দেশে নকল ওষুধের রমরমা ব্যবসার বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বলে দাবি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর।
ডিবির তথ্য অনুযায়ী, নকল মোনাস-১০ এর প্রতি ট্যাবলেট দুই থেকে তিন টাকা এবং সেকলোর প্রতি ট্যাবলেট দুই টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। দাম কম হওয়ায় এসব নকল ওষুধের বিক্রিও বেশি।
যে ক্ষতি করছে নকল ওষুধ
নকলকে আসল ভেবে যারা নিয়মিত এসব ওষুধ সেবন করছেন তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। স্বল্প মেয়াদি ক্ষতিসহ দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, নকল ওষুধ সেবনের ফলে অনেকের দেহে আসল ওষুধ কাজ না করার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জয় চৌধুরী বলেন, নকল ওষুধ সেবনের ফলে হার্ট, কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গর্ভবতী মা ও তার সন্তানের মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এসব ভেজাল ওষুধ। এছাড়া নকল অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ফলে পরবর্তীতে আসল অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা মানব শরীরে আর থাকছে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে ঔষধ আদালতে মামলা হয়েছে ১২টি। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬টি, মোবাইল কোর্টে হয়েছে ১২৫৮টি মামলা। জরিমানা করা হয়েছে এক কোটি ৮৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকা।
২০১৮-১৯ সালে ঔষধ আদালতে মামলা হয় সাতটি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৫৩টি, মোবাইল কোর্টে ২০২১টি। জরিমানা করা হয় ছয় কোটি ৫১ লাখ ২৮ হাজার ৯৩৯ টাকা।
২০১৯-২০ সালে ঔষধ আদালতে মামলা হয় দুটি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৪১টি, মোবাইল কোর্টে ১৯৬৪টি। জরিমানা করা হয় ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭০৮ টাকা।
২০২০-২১ সালে ঔষধ আদালতে মামলা হয় ১৩টি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯২টি, মোবাইল কোর্টে ১৭১৫টি। জরিমানা করা হয় সাত কোটি ৫৮ লাখ ১০০ টাকা। এসব অভিযানে মাঠপর্যায়ে নাপা, সেকলো, মোনাস, প্যারাসিটামলের মতো ওষুধ নকল অথবা নকল মোড়কে ভেজাল ওষুধ বিক্রির তথ্য উঠে আসে।
২০২০-২১ অর্থবছরে ২৬০টি মডেল ফার্মেসি চালু, ১৪ হাজার ৬৬৩টি মডেল মেডিসিন শপের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ড্রাগ লাইসেন্স না থাকায় ১১টি ফার্মেসি সিলগালা, ১৭১৫টিকে জরিমানা, ভেজাল বা নকল ওষুধ বিক্রি বা বাজারজাত করায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা হয়েছে ৯২টি।
নকল ওষুধ চেনার উপায়
ওষুধের প্যাকেটের গায়ে যে সিল থাকে সেটি ভালো করে দেখুন। কোথাও কোনো গলদ আছে কি না, লেবেল একই আছে কি না-ভালোভাবে দেখা।
আগে যদি আপনি একই ওষুধ কিনে থাকেন তাহলে পরের বার কেনার সময় আগের প্যাকেটের সঙ্গে প্যাকেজিং, অক্ষরের ফন্ট, বানান, রঙ- এগুলো মিলিয়ে দেখা।
ওষুধ খাবার আগে খেয়াল করুন এর রঙ, আকার, গঠন ঠিক আছে কি না। কোথাও কোনো ভাঙা অংশ রয়েছে কি না। গুঁড়া ওষুধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে দেওয়া আছে কি না-এসব ভালো করে দেখা।
ওষুধ যদি ক্রিস্টালের মতো হয় তাহলে যথেষ্ট শক্ত কিংবা অতিরিক্ত নরম কি না-ভালোভাবে দেখা। ওষুধের ভেতরে কোথাও ফোলা বা দাগ আছে কি না, তাও দেখা।
কখনও নির্দিষ্ট দামের চেয়ে কম দামে ওষুধ না কেনা।